প্রথম আলো: নির্বাচন নিয়ে সংশয় ছিল, নির্বাচন হয়েছে। নতুন সরকার কাজও শুরু করেছে। কিন্তু ভোটের হার কম, গ্রহণযোগ্যতার সংকটের কথাও উচ্চারিত হচ্ছে। এ ধরনের সরকার সুশাসন নিশ্চিতে কী কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে?
ইফতেখারুজ্জামান: আমরা পুরো প্রক্রিয়াটি যাচাই করেছি আসলে রাজনৈতিক শুদ্ধাচার ও নৈতিকতার মানদণ্ডে। সুশাসনের মূলে থাকে জবাবদিহি। জনগণের যদি সরকারের ওপর আস্থা থাকে বা তারা যদি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে সরকারের জবাবদিহির যে মৌলিক ধাপগুলো আছে, তার প্রথমটা পূরণ হয়ে যায়। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী সরকার তো জনগণের। জনগণের রায়ের ওপর ভিত্তি করে জনগণ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার কাজ করে। তাই জন আস্থার বিষয়টা প্রথমেই আসে। সামনের দিনগুলোতে দেখতে হবে নীতিকাঠামো, আইন ও প্রতিষ্ঠানগুলোয় জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন কতটুকু ঘটছে। দ্বিতীয়টি হচ্ছে নীতিকাঠামো, আইনিকাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের কাছে কতটুকু জবাবদিহিমূলক হলো।
প্রথম আলো: সেদিক থেকে সরকারের কাছ থেকে কতটা আশা করা যায়? আওয়ামী লীগ, স্বাধীন আওয়ামী লীগ ও নির্ভরশীল আওয়ামী লীগ এবং অন্য দলের হাতে গোনা কিছু সদস্য এই নিয়েই সরকার ও সংসদ...
ইফতেখারুজ্জামান: এর তিনটি আঙ্গিক আছে। প্রথমটা হলো বিতর্ক থাকবে। হয়তো চিরকালই থাকবে। এটা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। সুশাসনের বিষয়টা শুধু এই নির্বাচনের ওপর নির্ভরশীল নয়। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে একটা শাসনকাঠামো তৈরি হয়েছে। জবাবদিহির জন্য যে মৌলিক উপাদানগুলো থাকার কথা, সেগুলো কাগজে-কলমে আছে। কিন্তু সেগুলোর কার্যকারিতা খুবই দুর্বল। এর সঙ্গে এখন নতুন যে আরেকটি উপাদান যোগ হলো, তা হলো শাসনকাঠামোটা একচ্ছত্র হয়ে গেছে। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের সিংহভাগ ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী, যাঁরা স্বতন্ত্র, তাঁরাও ক্ষমতাসীন দলের সদস্য। তাঁদের পরিচিতি, রাজনীতি সবই হলো ক্ষমতাসীন দলের। আরও যাঁরা আছেন, তাঁরাও ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকগোষ্ঠী। অল্প কিছু আছেন, যাঁরা এর বাইরে। সংসদের বিশাল অংশ যদি একটি দলের করায়ত্ত হয়, তখন শাসনকাঠামো একচ্ছত্র না বলে আর উপায় থাকে না। সরকারি কার্যক্রমে জনপ্রত্যাশা কতখানি প্রতিফলিত হবে, তার আগে যে বিষয়টি আসল, তা হলো জবাবদিহির কোনো কাঠামোই আর থাকল না।
প্রথম আলো: আর সংসদ?
ইফতেখারুজ্জামান: সংসদের কথা যদি বলি, সংসদ তখনই কাজ করে, যখন জনগণের প্রতিনিধিত্ব থাকে। তা ছাড়া তার কাজ আইন প্রণয়ন ও সংস্কার করা এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জনগণের পক্ষ হয়ে সরকারকে জবাবদিহি করা। এই তিনটি কাজের কোনোটিই বাস্তবে হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, এই সংসদে চেকস অ্যান্ড ব্যালান্স বলতে যেটা বোঝায়, সেটা অনুপস্থিত থাকবে। সংসদের সফলতা নির্ভর করবে যদি দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে সংসদ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। এটা আমরা শুধু আশাই করতে পারি, আদৌ সম্ভাবনা কতটুকু তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাবে।
প্রথম আলো: আমরা একটু টিআইবির প্রতিবেদনের দিকে যাই। টিআইবি বলেছে নির্বাচন কমিশন সরকারের নিরপেক্ষ ও স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত ভূমিকা নিশ্চিতে আইন সংস্কারের প্রস্তাব কমিশন করেনি। আরও বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ আছে। নির্বাচন কমিশনের কী করার ছিল?
ইফতেখারুজ্জামান: নির্বাচন কমিশনকে নিয়ে টিআইবি ধারাবাহিকভাবে গবেষণা করেছে। আগের দুটি নির্বাচনেও আমরা পরিবীক্ষণ বা ট্র্যাকিং করেছি। আমরা আলাদাভাবে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বসেছিলাম। নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিকভাবে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার এখতিয়ার আছে। আর সরকারসহ সব প্রতিষ্ঠানের কমিশনকে সহযোগিতা করার আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে। আগের দুই নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিয়ে সংকট দেখা গিয়েছিল।
এবার এই সংকট আরও প্রকট হয়েছে। বিএনপি যেটা বলছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ধারণা, আমাদের সেদিকে যাওয়ার কোনো কারণ নেই। নির্বাচনকালীন সরকারকে আমরা যে নামেই অভিহিত করি না কেন, তার ভূমিকাকে নিরপেক্ষ, স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত করা নিশ্চিত করা যায়। যে যে কারণে সরকারের পক্ষে নিরপেক্ষ বা স্বার্থের দ্বন্দ্বমুক্ত হওয়া সম্ভব নয় বা যে যে কারণে আস্থা সৃষ্টি করা যাচ্ছে না, সেগুলো চিহ্নিত করে কমিশন কিছু আইনি পরিবর্তন বা সংস্কারের প্রস্তাব তুলতে পারত। কমিশন যদি এটা করত, অন্তত তাদের মনে এই আত্মবিশ্বাসটা জন্মাত যে তাদের কাছে মানুষের যে প্রত্যাশা, সেটা তারা পূরণ করতে পারল।