তিনটি দৃষ্টিকোণ থেকে সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচিত হয়। এক. কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি ধারণা হিসেবে; দুই. প্রবৃদ্ধি বলয়ের বাইরে যাদের অবস্থান এবং যারা নিজেরা নিজেদের সুরক্ষা করতে পারে না, তাদের সহায়তা হিসেবে এবং তিন. সেই সঙ্গে একটি সমাজের দারিদ্র্য ও অসমতা দূর করার একটি পন্থা হিসেবে।
সামাজিক সুরক্ষাকাঠামোর নানা কর্মসূচি ও উপকরণ রয়েছে, যেমন প্রতিবন্ধী সহায়তা থেকে বেকারত্ব ভাতা, শিশুকল্যাণ ভাতা থেকে শর্তযুক্ত অর্থ হস্তান্তর। বিগত দশকগুলোয় বিভিন্ন দেশে সর্বজনীন ন্যূনতম আয় নিয়ে বিশেষ একটি পরীক্ষামূলক সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
সর্বজনীন ন্যূনতম আয় বিষয়টির কয়েকটি দিকের ব্যাপারে ধারণার স্বচ্ছতা প্রয়োজন।
প্রথমত, সর্বজনীন ন্যূনতম ধারণাটির ‘সর্বজনীনতা’ বিষয়টি বিভ্রান্তিমূলক হতে পারে। এখানে ‘সর্বজনীনতা’ মানে সামগ্রিকভাবে একটি দেশ বা সমাজের সবাই নয়, বরং সর্বজনীন ন্যূনতম আয় ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে সর্বজনীনতার অর্থ হচ্ছে সমাজে যারা এ আয়প্রাপ্তির যোগ্যতা অর্জন করেছে, তারা প্রত্যেকেই অন্য সব বিবেচনা নির্বিশেষে (যেমন তারা প্রতিবন্ধী সহায়তা পায় কি না, অথবা তারা বৃদ্ধ ভাতা লাভ করে কি না) এ আয় প্রাপ্ত হবে।
দ্বিতীয়ত, যদিও বেশ দীর্ঘ সময় ধরে বৈশ্বিকভাবে সর্বজনীন ন্যূনতম আয় বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু বিশ্বের কোনো দেশই এখন পর্যন্ত জাতীয় পর্যায়ে স্থায়ীভাবে এ–জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণ বা বাস্তবায়ন করেনি। একাধিক দেশ এ কর্মসূচির ওপর কাজ করেছে, কিন্তু তার সব কটিই স্থানীয় পর্যায়ে পরীক্ষামূলক প্রকল্পমাত্র।
যেমন ১৯৭৪ সালে ক্যানাডা তার ম্যানিটোবা প্রদেশের মিনকোমে একটি ন্যূনতম আয় কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। তেমনিভাবে ২০০৮ ও ২০০৯ সালে নামিবিয়া দেশটির ওটজিভেরো-ওমিটারা অঞ্চলের প্রত্যেক বাসিন্দাকে প্রতি মাসে ১০০ নামিবিয়ান ডলার দিয়েছিল। ফিনল্যান্ড ২০১৭-১৮ সালে ২ হাজার বেকার মানুষকে প্রতি মাসে ৫৬০ ইউরো প্রদান করেছিল।
তৃতীয়ত, সর্বজনীন ন্যূনতম আয় কর্মসূচির ওপরে এখনো নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। যেমন যুক্তরাজ্য পরিকল্পনা করছে যে একটি ন্যূনতম আয়ের পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা দেশটি অনতিবিলম্বেই গ্রহণ করবে। এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে ২ বছরের জন্য ৩০ জন বেকার মানুষের প্রত্যেককেই প্রতি মাসে ১ হাজার ৬০০ পাউন্ড করে দেওয়া হবে।
পরীক্ষামূলক সর্বজনীন ন্যূনতম আয় কর্মসূচির তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ।
এক. এই কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য দরিদ্র মানুষের বঞ্চনা এবং বহির্ভুক্তি হ্রাস করা। সে প্রত্যাশা অর্জিত হচ্ছে কি না, তার মূল্যায়ন হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে দেখা দরকার, সর্বজনীন ন্যূনতম আয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের গৃহীত প্রক্রিয়া দক্ষ এবং কার্যকর কি না।
দুই. ন্যূনতম আয় হস্তান্তরের ফলে যারা এর সুবিধাভোগী, তাদের কাজ করার ইচ্ছার ওপরে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কি না, সেটা পরীক্ষা করা দরকার।
তিন, পরীক্ষামূলক আয় হস্তান্তর কর্মসূচির মাধ্যমে নির্ণয় করা যে একটি সর্বজনীন ন্যূনতম আয় কর্মসূচির ব্যয় কী পর্যায়ের হতে পারে। এসব বিষয়ের উত্তরের ওপরেই পরীক্ষামূলক সর্বজনীন ন্যূনতম আয় কর্মসূচির বিস্তার এবং অন্যান্য দেশে এর বাস্তবায়নের বিষয়টি নির্ভর করছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে সর্বজনীন ন্যূনতম আয় কর্মসূচি গ্রহণ সম্পর্কে যে আলোচনা চলছে, সে পরিপ্রেক্ষিতে উপর্যুক্ত বিষয়গুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আজকের বাংলাদেশে একটি বৈষম্যহীন সমাজ গঠনকল্পে জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে সর্বজনীন ন্যূনতম আয় ধারণাটি অত্যন্ত সংগতিপূর্ণ।