দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে যে রাজনৈতিক উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল, তা অনেকখানি থিতিয়ে এসেছে। আওয়ামী লীগ টানা চার মেয়াদে ক্ষমতায় বসেছে। কিছুদিন নিশ্চুপ থাকার পর বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো ফের রাজপথে নামার চেষ্টা করছে। কতটা পারছে, এখনই স্পষ্ট নয়। চাইলেও ঠিক মতো নামতে পারছে না ক্ষমতাসীন দলের হম্বিতম্বির কারণে।
শুধু কি হম্বিতম্বি? গত বুধবার নাটোর ও পটুয়াখালীতে দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তির দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে হামলাও হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এতে শহীদুল ইসলাম বাচ্চুকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। আশঙ্কাজনকভাবে তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। (সমকাল, ৪ জুলাই ২০২৪)।
বলা বাহুল্য, আমাদের দেশের গত সাধারণ নির্বাচনে তেমন কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। সরকারবিরোধী বলে পরিচিত কোনো দলই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলতে যা ঘটেছে তা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘স্বতন্ত্র’দের। স্বতন্ত্ররাও আওয়ামী লীগেরই লোক। আগেরকালে এদের বলা হতো ‘বিদ্রোহী’; এখন বলা হচ্ছে স্বতন্ত্র, এবং পরোক্ষে অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে তাদের ওই স্বাতন্ত্র্যকে। মাত্র একজন প্রার্থী যদি থাকে তবে তো ভোটাররা আসবে না; ভোটারদের আনা দরকার; ফাঁকা গোলকে তো গোল বলা যাবে না, এমনকি পেনাল্টি শটে জেতার জন্যও তো একটা বন্দোবস্ত প্রয়োজন, তাই না? নির্বাচনের একের অধিক প্রার্থী তাই অত্যাবশ্যক। ভোটারদের সুযোগ দেওয়া চাই বাছবিচারের। ভোটাররা অবশ্য পাঁচ বছর পার-করে-প্রাপ্ত তাদের ওই সুযোগ প্রয়োগ করতে তেমন একটা উৎসাহ দেখায়নি।
এই রকমের নির্বাচনেই নির্বাচিত হয়ে এসেছেন নাটোরের অ্যাডভোকেট আবুল কালাম আজাদ। প্রকাশ্যেই তিনি ঘোষণা করে দিয়েছেন যে নির্বাচিত হওয়ার জন্য তাঁকে খরচ করতে হয়েছে ১ কোটি ২৬ লক্ষ টাকা। এই টাকা তিনি তুলে নেবেন। দরকার হলে অনিয়ম করে। অনিয়ম করেই যে তুলতে হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিয়মমাফিক পথে উদ্ধার করা তো আকাশকুসুম কল্পনা-বিলাস।
আর ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর ব্যবস্থাপনায় নিহত তিন তিন বার ‘নির্বাচিত’ ঝিনাইদহের যে এমপি–আনওয়ারুল আজীম–অমন অগাধ অর্থের মালিক হয়েছিলেন সেটাও নিশ্চয়ই বৈধ পথে ঘটেনি; শোনা যাচ্ছে ঘটেছে স্বর্ণ চোরাচালান ও মাদক ব্যবসার মধ্য দিয়ে; যে কাজে তিনি তাঁর পদকে ব্যবহারে কোনো প্রকার কার্পণ্যই করেননি।
পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যখন প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তার প্রতিষ্ঠাতা, এবং সে-সময়কার ‘জাতির পিতা’ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সাহেব গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে নতুন রাষ্ট্রের নাগরিকদের এই বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি যেন প্রশ্রয় না পায়। বলেছিলেন, প্রশ্রয় পেলে তারা কিন্তু ভয়াবহ রকমের ক্ষতির কারণ হবে।
পাকিস্তান রাষ্ট্রে ওই দুই জিনিসই ছিল সর্বাধিক তৎপর। বাংলাদেশ রাষ্ট্র আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এবং ওই রাষ্ট্রকে ভেঙে ফেলে। কিন্তু দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি তো অক্ষতই রয়ে গেছে। কমবে কই, বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। দুর্নীতি ছাড়া উন্নতি নাই।
আর স্বজনপ্রীতি যে কেমন দুর্ধর্ষ হতে পারে তার প্রকাশ্য ও ব্যাপক প্রমাণ তো পাওয়া গেল সদ্য সম্পন্ন উপজেলা নির্বাচনে। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতাটা জাতীয় নির্বাচনে যেমন ছিল ঠিক তেমনই ঘটেছে; অর্থাৎ নিজেদের মধ্যেই, ঘরে ঘরেই। হাইকমান্ড থেকে কড়া নিষেধ ছিল, খবরদার, মন্ত্রী ও এমপি’দের আত্মীয়স্বজনেরা যেন নির্বাচনে না দাঁড়ান, এবং নির্বাচন প্রক্রিয়াতে তাঁরা কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ যেন না করেন। সে নির্দেশ কতজন মান্য করেছেন জানা যায়নি, তবে বহুজন যে অমান্য করেছেন তার খবর পত্রপত্রিকায় এসেছে।
রাজনীতিকে তাও কোনোভাবে সামাল দেওয়া যাচ্ছে; সমাজকে কীভাবে সামাল দেবে? রাজনৈতিক হম্বিতম্বিতে বিরোধী দলের পিলে চমকাচ্ছে বটে, সামাজিক হতাশা তাতে কমছে না মোটে। সামাজিক হতাশা কোথায় পৌঁছে গেছে, সাম্প্রতিক তিনটি খবরে তা স্পষ্ট।