পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সব প্রশ্নে একমত হওয়া সম্ভব নয় এবং তা কেউ প্রত্যাশাও করেন না। কিন্তু কিছু বিষয় থাকে সেখানে একমত হওয়া প্রয়োজন। রাজনীতিকে খেলার সঙ্গে তুলনা করতে পছন্দ করছেন ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা এবং ‘খেলা হবে’ কথাটিকে বহুভাবে ব্যবহার করেছেন। আর আন্দোলনকে খেলার সঙ্গে তুলনা করার চল তো বহুদিনের। এখন সেমিফাইনাল, এরপর হবে ফাইনাল এ রকম কথা জনগণ শুনেছে বহুবার। কিন্তু খেলা হতে গেলেও তো কখন খেলা হবে সে বিষয়ে একমত হতে হয় না হলে একপক্ষ যদি খেলতে না আসে, তাহলে নিয়ম অনুযায়ী ওয়াকওভার পেয়ে বিজয়ী হবে অপরপক্ষ। তাতে নিয়ম রক্ষা হয় কিন্তু খেলার আনন্দ আর বিজয়ের গৌরব কোনোটাই থাকে না। কারণ খেলাটা শুধু জয়-পরাজয়ের নয়, আনন্দেরও। রাজনীতিকে খেলার সঙ্গে তুলনা করাটা খুবই নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। তারপরও যারা একে খেলা বানিয়ে ফেলতে উঠেপড়ে লেগেছেন, তারাও খেলার আনন্দ ও উত্তেজনার চাইতে খেলা নিয়ে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা করছেন বেশি।
নির্বাচনকে নিয়ে উত্তেজনা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। নির্বাচনের জন্য বহুপাক্ষিক অংশগ্রহণ, আয়োজন ও সমঝোতা প্রয়োজন হয়। নির্বাচনে ভোট দেবে জনগণ, ভোট নিয়ে ক্ষমতায় যাবে রাজনৈতিক দল, নির্বাচনের আগে-পরে শৃঙ্খলা রক্ষা করবে পুলিশ ও প্রশাসন আর নির্বাচন পরিচালনা করবে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের প্রচারণার জন্য প্রয়োজন ভয়হীন সুষ্ঠু পরিবেশ, যাতে ভোটাররা ভোটের আগে এবং ভোটের ফলাফল যাই হোক না কেন, ভোটের পরও নিরাপদ থাকতে পারেন। রাজনৈতিক দল যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন তাদের প্রত্যাশা থাকে তারা যেন সুষ্ঠু পরিবেশ পান, সমান সুযোগ পান, নির্বাচনী কর্র্তৃপক্ষ যেন নিরপেক্ষ আচরণ করেন, পুলিশ এবং প্রশাসন যেন পক্ষপাতিত্ব না করেন এক কথায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড যেন সৃষ্টি করা হয়। নির্বাচন কমিশনের দরকার সংবিধানসম্মত ক্ষমতা এবং তা ব্যবহার করার অধিকার। কমিশন চাইলে রাষ্ট্রীয় দপ্তরগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন মাফিক সহায়তা করেন। কিন্তু এসব প্রয়োজন এবং প্রত্যাশা চাপা পরে যায় ক্ষমতাসীন দলের চাওয়ার কাছে। ক্ষমতাসীন দল যদি চান তারা আবার জিতবেন তাহলে রাষ্ট্রের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে নির্বাচনে জিতে আসবেন। অতীত ইতিহাস বলে এমন ঘটনা হয়েছে, একবার-দুবার নয়, বারবার।
বাংলাদেশে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। সে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছিল। দলীয় সরকারের ভূমিকা নির্বাচনকালে তখন নিরপেক্ষ ছিল না এবং তার স্মৃতিটাও খুব একটা সুখকর নয়। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল ১৯৭৯ সালে। সেই নির্বাচনেও সদ্য গড়ে ওঠা দল সংবিধান সংশোধনের মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসন নিয়ে বিপুল বিজয় অর্জন করেছে। তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৯৮৬ সালে। তখনো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতদের সহায়তায় ক্ষমতায় থেকে গড়ে ওঠা দল সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় আসন হাতে রেখে বাকিগুলো বণ্টন করে দিয়েছিল নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে। একই ঘটনা ঘটেছে ১৯৮৮, ১৯৯৬, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে। ফলে এটা পরিষ্কার যে, ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করে কেউ হারেনি এবং ক্ষমতাসীনদের বিপরীতে যত জনপ্রিয়তা নিয়ে বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক না কেন, তারা ক্ষমতায় যাওয়ার মতো আসন নিয়ে নির্বাচনে জিততে পারেনি।