গত ২৫ অক্টোবর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের সভাকক্ষে ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন : গণমাধ্যমের ভূমিকা, জাতির প্রত্যাশা’ শিরোনামে আয়োজিত সংলাপে সমাপনী বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে প্রয়োজনে সারা দেশের ভোট বন্ধ করে দেওয়া হবে।’ ভোট যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, তিনি সেজন্য সংশ্লিষ্ট সবার সহায়তা চেয়েছেন। এখানে যে প্রশ্ন উঠতে পারে তা হলো, সারা দেশে ভোট বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা ও সাহস ইসির আছে কি?
জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ন্ত্রিত হয় মূলত বাংলাদেশের সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২ দ্বারা। সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের নির্দেশনার আলোকে গঠিত নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ওপর ন্যস্ত হয়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব। সংবিধানের ১১৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জাতীয় সংসদের নির্বাচনের জন্য ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণের তত্ত্বাবধান, নির্দেশ ও নিয়ন্ত্রণ এবং এ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব ইসির ওপর ন্যস্ত থাকবে এবং ইসি এ সংবিধান ও আইনানুযায়ী সংসদ-সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ইসির দায়িত্বপালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব হবে। আরপিওতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রক্রিয়ার বর্ণনা রয়েছে। অনিয়মের কারণে ইসি কর্তৃক জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টি আরপিও’র ৯১(এ) অনুচ্ছেদে বিধৃত হয়েছে। সম্প্রতি এ অনুচ্ছদে কতিপয় সংশোধনী আনা হয়েছে, যা নির্বাচনে অনিয়মের কারণে ইসির ভোট বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা কিছুটা খর্ব করেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশোধনের আগে আরপিও’র ৯১ অনুচ্ছেদের (এ) দফায় যা বলা হয়েছিল তা হলো, ‘The commission may stop the polls at any polling station or entire constituency, as the case may be, at any stage of the election if it is convinced that it shall not be able to ensure the conduct of the election justly, fairly and in accordance with law due to malpractices, including coercion, intimidation and pressures, prevailing at the election', যার অর্থ দাঁড়ায়-কমিশন যদি এই মর্মে আত্মপ্রত্যয়ী হয় যে, নির্বাচনে বল প্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন এবং চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সংগত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না, তাহলে কমিশন যে কোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমতো সম্পূর্ণ নির্বাচনি এলাকায় নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ে ভোটগ্রহণসহ নির্বাচনি কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে। সংশোধনীতে ‘at any stage of the election’ শব্দগুলোর ‘election’ শব্দকে ‘polling’ শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইলেকশন বলতে বোঝায় তফশিল ঘোষণার পর থেকে ফল ঘোষণা পর্যন্ত সময়কালকে। এখন election শব্দের স্থলে polling শব্দ প্রতিস্থাপনের ফলে কমিশন তার ওপর প্রদত্ত ক্ষমতা শুধু ভোটের দিন প্রয়োগ করতে পারবে। দ্বিতীয়ত, এ সংশোধনী একটি নির্বাচনি এলাকার পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট সেন্টারের নির্বাচন স্থগিতের ক্ষমতা কার্যত নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতাকে সংকুচিত করেছে।
বিলটির আলোচনায় অংশ নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘এবার যে সংশোধনী আনা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, কোনো একটা পোলিং সেন্টারে যদি গন্ডগোল দেখা যায়; ধরেন আমার নির্বাচনি এলাকায় ১১৪টি কেন্দ্র রয়েছে, এখানে যদি দুই-তিনটা কেন্দ্রে গন্ডগোল হয়, তাহলে এসব কেন্দ্রের নির্বাচন বন্ধ করতে পারে ইসি। কিন্তু বাকি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করার ক্ষমতাটা এ আইনে দেওয়া হয়নি’ (আমাদের সময়, ৬ জুন)। এ থেকে স্পষ্ট হয়, অনিয়মের কারণে ইসি কোনো নির্বাচনি এলাকার দু-চারটি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করতে পারলেও মোটামুটি সুষ্ঠুভাবে ভোট হওয়া কেন্দ্রগুলোর ভোট বন্ধ করতে পারবে না। এর অর্থ দাঁড়ায়-গত বছরের ১২ অক্টোবর গাইবান্ধা-৫ নির্বাচনি এলাকার কিছুসংখ্যক ভোটকেন্দ্রে অনিয়ম হওয়ার দৃশ্য ঢাকায় নির্বাচন ভবনে বসে সিসিটিভির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে ইসি ওই নির্বাচনি এলাকার ভোট বন্ধ করে দেওয়ার যে সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে কোনো নির্বাচনি এলাকার কিছুসংখ্যক ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের কারণে ইসি ওই নির্বাচনি এলাকায় ভোট বন্ধের পরিবর্তে কেবল অনিয়ম সংঘটিত হওয়া ভোটকেন্দ্রগুলোর ভোট বন্ধ করতে পারবে। আরও উল্লেখ্য, অনিয়মের কারণে কোনো নির্বাচনি এলাকার দু-চারটি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করা হলেও তা ওই নির্বাচনি এলাকায় বিজয়ী প্রার্থী ঘোষণায় সমস্যা না-ও হতে পারে।