সম্প্রতি এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলকে আশ্বস্ত করেছেন যে, আসন্ন সংসদীয় নির্বাচনকে অবাধ ও নিরপেক্ষ করার ব্যাপারে তিনি সরকারের তরফ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছেন। এখন সরকারকে সঠিক সাহায্য প্রদানের কথা বলতে হবে তাকে।
নির্বাচন যাতে অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়, সেজন্য আওয়ামী লীগের পীড়াপীড়িতে বিএনপি ও অন্যান্য দল নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা যথারীতি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করেছিল।
কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তড়িঘড়ি করে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে সংবিধানে এমন সংশোধনী সংযোজন করে, যেখানে ক্ষমতাসীন তথা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ সংশোধনী এতটাই বিতর্কিত যে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় যেতে চাই না।
এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তা হলো, যে আওয়ামী লীগ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার অপরিহার্য বিবেচনা করেছিল, সেই আওয়ামী লীগ সংবিধানে পরিবর্তন এনে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে চলেছে। আর তখন থেকে প্রতিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করেছে। তাই আওয়ামী লীগ আর নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনবোধ করছে না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার সরকারের অবস্থানগত স্ববিরোধিতার বিষয়টি তুলে ধরছেন না।
দলীয় সরকারের অধীনে আসন্ন নির্বাচনে জনগণ যে অবাধে ভোট প্রদান করতে পারবে, তার কী নিশ্চয়তা দিচ্ছে সরকার? সেটা তো প্রধান নির্বাচন কমিশনার ব্যাখ্যা করে বলছেন না। সংসদীয় ব্যবস্থায় নির্বাচিত সরকারের অধীনে কোথাও নির্বাচন করা হয় না, নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অবশ্যই জানতে হবে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে তার নিজস্ব এক ভোটের ব্যবধানে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে রায় দিয়ে বললেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচনকালেও জনগণের নির্বাচিত সরকার থাকতে হবে। নির্বাচনকালে কেয়ারটেকার সরকার বৈধ নয়। অন্যান্য কোনো দেশেই যে নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় না, তা বুঝতে চাইলেন না।
নির্বাচিত সরকার ও রাষ্ট্রপতির মনোনীত ব্যক্তিদের দ্বারা গঠিত সরকারের মধ্যেকার পার্থক্য বোঝার মতো রাজনৈতিক নেতৃত্বও আমাদের নেই। প্রতিবার নির্বাচনে বিজয় অর্জন করার এমন নিশ্ছিদ্র ভোট কারচুপির ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে জনগণ তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারল কিনা সেটা বিবেচ্য বিষয় নয় এবং এ সম্পর্কে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কিছু জানারও প্রয়োজনবোধ করছেন না। এ ব্যবস্থাধীনে নির্বাচন কারচুপি করবে সরকারি কর্মকর্তারা, আর তা দূর থেকে তদারকি করবেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এবং নির্বাচনি নাটক প্রযোজনা করবে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কারচুপি যে সরকারি কর্মকর্তারা করবে, তাদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের কোনো সম্পর্ক থাকবে না, তারা তাদের কাজ করবেন দৃষ্টির আড়ালে থেকে। নির্বাচন প্রতারণার এ মহাপরিকল্পনা কার্যকর করার জন্যই ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষমতায় থাকা এতটা গুরুত্বপূর্ণ।