‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান/অপমান হতে হবে তাহাদের সমান/মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে/সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান/অপমান হতে হবে তাহাদের সবার সমান’। রবিঠাকুর তার ‘অপমানিত’ কবিতায় বিধাতার পক্ষ থেকে অবধারিত অপমান ও রুদ্ররোষের কথা এভাবেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
কাব্যাংশটি মনে পড়ল দেশ তোলপাড় করা একটি আটকের ঘটনায়। শুক্রবার রাতে সিলেটের কানাইঘাট সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় আটক হন সুপ্রিমকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। ১৬ বছরের আওয়ামী দুঃশাসনে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত ও কলুষিত করার জন্য তিনি ব্যাপকভাবে আলোচিত-সমালোচিত। বহুল বিতর্কিত ও ধিকৃত এই বিচারকের আটক ও পরবর্তী কিছু ঘটনা টক অব দ্য কান্ট্রি শনিবার থেকে। ভাইরাল হয় প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তার কিছু বক্তব্য। আদালতে তোলার সময় জনরোষের শিকার হওয়ার ভিডিও অন্তর্জালে সয়লাব।
৫ আগস্টের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা পালিয়েছেন ভারতে। তার অনুগামী হয়ে আরও অনেক রাজনৈতিক নেতাই ভারতে পালানোর চেষ্টা করে কেউ সফল হয়েছেন, কেউবা আটকা পড়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বা অভ্যুত্থানে সরকারের পতন হলে পতিত সরকারের মন্ত্রী-নেতারা পলায়ন করেন, রোষানল থেকে বাঁচার প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন-এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু বিচারকের মতো সাংবিধানিক পদধারী, পেশাজীবী, কথিত বুদ্ধিজীবীদেরও পালাতে হয় কেন, এ প্রশ্ন সামনে আসছে বেশ জোরেশোরেই।
চৌধুরী মানিক ধরা পড়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খবর আসে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান পান্না পালিয়ে ভারতে প্রবেশের পর মারা গেছেন। শুক্রবার মধ্যরাতে মেঘালয়ের শিলং পাহাড়ে ওঠার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হয় বলে তথ্য পাওয়া গেছে। আওয়ামী সরকার পতনের পর ভারতে পালাতে গিয়ে প্রথমে আটকা পড়েন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও ভোরের কাগজ পত্রিকার সম্পাদক শ্যামল দত্ত। আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভারতে যাওয়ার সময় ইমিগ্রেশন তাকে আটকে দেয়। দেশ ছাড়ার সময় ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও আটকা পড়েন অনেকে। প্রতাপশালী সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ কর্মকর্তা, সাংবাদিক দম্পতি থেকে শুরু করে অনেকেই দেশ ছেড়ে পালানোর সময় আটক হন।
ক্ষমতার পালাবদলে বিচারক মানিকদের কেন জল-জঙ্গল পেরিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালাতে হয়, সে বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে শুক্রবার তার পলায়ন ও পাকড়াওর আলোচিত ঘটনায় চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে স্থানীয় জনতার সহায়তায় শামসুদ্দিন চৌধুরীকে আটক করে বিজিবি। পরে শনিবার সকালে তাকে কানাইঘাট থানায় হস্তান্তর করা হয়। বিকালে আদালতে তোলার পর তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। ৫৪ ধারায় মামলা দিয়ে তাকে আদালতে উপস্থাপন করা হয় বলে জানা গেছে। অবশ্য আটকের আগে এবং আদালতে তোলার সময় তিনি জনরোষে পড়েন। হন লাঞ্ছিত।
ডিম, জুতা, কিল, ঘুষি, লাথির আঘাত নিয়েই আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় দাম্ভিক এ সাবেক বিচারককে। পরে সেনা পাহারায় আদালত থেকে তাকে নিরাপদে বের করা সম্ভব হয়। পালানোর সময় সীমান্তে মারধরের সময় তার অণ্ডকোষ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। সিলেট ওসমানী মেডিকেলে শনিবার রাতে তার অস্ত্রোপচার শেষে সেখানে তিনি পোস্ট-অপারেটিভে রয়েছেন বলে সর্বশেষ খবরে জানা যাচ্ছে।
১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে সীমান্ত পার করে দেওয়ার জন্য স্থানীয় দালালদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন শামসুদ্দিন চৌধুরী। সীমান্ত পারও হয়ে গিয়েছিলেন। আটকের সময়ের দুটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সীমান্তবর্তী এলাকায় ধারণ করা একটি ভিডিওতে শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘আমি এই দেশে (ভারত) এত কষ্ট করে এসেছি কি বাংলাদেশে ফেরত যাওয়ার জন্য?’
চৌধুরী মানিককে আটক করার পরের আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, একজন ব্যক্তি শামসুদ্দিনের গলায় থাকা গোলাপি রঙের মাফলার বা গামছা ধরে আছেন। তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হচ্ছে। শামসুদ্দিনকে তখন আতঙ্কিত, ভীত ও হতাশ দেখাচ্ছিল। ওই ভিডিওতে পালানোর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন-‘ভয়ে পালাইতেছি।’ ‘কার ভয়ে’ জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে শামসুদ্দিন বলেন, ‘প্রশাসনের ভয়ে।’