৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর চারদিকে আনন্দ-উৎসব হবে, এটাই স্বাভাবিক। মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে এসে বিজয় মিছিল করবে, স্লোগানে স্লোগানে চারদিক মুখরিত হবে, এটাই প্রত্যাশিত। রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে হয়েছেও তাই। এরশাদবিরোধী আন্দোলন শেষেও এমনই আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এবারের আন্দোলন শেষে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় বিজয়ের উৎসবের পাশাপাশি যে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটেছে, তা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ৫ আগস্ট দুপুরে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বিক্ষুব্ধ জনতা গণভবনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। গণভবনে প্রবেশ করে তারা সরকারি আসবাবপত্র থেকে শুরু করে রান্নাঘরের তৈজসপত্র পর্যন্ত লুটপাট করে নিয়ে যায়। হাঁস-মুরগি, মাছ, বাগানের সবজিও বাদ যায়নি। ঢাকাসহ বাইরের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলন দমনের নামে পুলিশ যে নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, এর প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন জেলার থানা আক্রমণের শিকার হয়েছে। একই সঙ্গে দুর্বৃত্তরা পুলিশকে হত্যা করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটপাট করে নিয়ে গেছে। অগ্নিসংযোগ করে পুলিশের গাড়ি ও থানাভবন পুড়িয়ে দিয়েছে। যদিও এরই মধ্যে পাঁচ শতাধিক অস্ত্র ও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে যে স্পর্শকাতর বিষয়টি ঘটেছে তা হলো, দেশের কোনো কোনো স্থানে সংখ্যালঘু ও তাদের বাড়িঘর আক্রমণের শিকার হয়েছে। তাদের বাড়িঘর লুটপাট-অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। এ অনৈতিক আক্রমণের হাত থেকে মন্দিরও রেহাই পায়নি। আরও একটি বিশেষ ঘটনা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত মনে হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত, বিশেষ করে মুক্তিসংগ্রামের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। এ কাজটি সম্পূর্ণ অন্যায্য মনে হয়েছে। এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, আওয়ামী লীগের ১৫ বছর স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অর্জিত বিজয়কে কিছুটা হলেও ম্লান করে দিয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক শহিদ আবু সাঈদকে রংপুরে প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করার পর আন্দোলন আরও বেগবান হয়। আবু সাঈদ ঘাতকদের অস্ত্রের মুখে বুক পেতে দিয়ে যে অকল্পনীয় সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, তা খুব দ্রুত আন্দোলনকারী প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মধ্যে সঞ্চারিত হয়। ফলে পুলিশ আন্দোলনের জোয়ার আর ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। তারপরই দেখা গেছে, পুলিশের গুলি খেয়ে একজন রাস্তায় লুটিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও দশজন এগিয়ে গেছে। সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা গেছে, একজন পুলিশ কর্মকর্তা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালকে ব্রিফ করছেন। গুলি খেয়ে একজন শিক্ষার্থী মারা গেলে কিংবা আহত হলেও অন্য শিক্ষার্থীরা পিছু হটছেন না, শিক্ষার্থীদের এমন প্রবৃত্তি দেখে পুলিশ সদস্যরাও কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েন। আবু সাঈদের পথ ধরেই বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন। পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে সরকার আন্দোলন দমনে দেশব্যাপী কারফিউ দিয়ে সেনাবাহিনী নামিয়ে দেয়। ব্যক্তিগত যোগাযোগের সুবিধা থাকায় আমি সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, সেনাবাহিনী চূড়ান্তভাবে প্রয়োজন না হলে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েই মাঠে নেমেছিল। যদিও অতি উৎসাহী কিছু কর্মকর্তা কিছুটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। কিন্তু তাই বলে আন্দোলনের তীব্রতা কমে যায়নি। এ সময় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেন। ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এ আন্দোলনে শামিল হতে থাকেন। ফলে কোটা সংস্কার আন্দোলন স্বৈরাচার উৎখাতের আন্দোলনে রূপ নেয়। শিক্ষার্থীরা ৯ দফা দাবি থেকে সরে এসে সরকার পতনের ১ দফা আন্দোলনের ডাক দেন। আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের নির্বিচার গুলিবর্ষণে মৃত্যুর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। একপর্যায়ে এ সংখ্যা দুইশত ছাড়িয়ে যায়।
এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরেও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। একটি কথা মনে রাখতে হবে, সেনাবাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শত্রুকে ঘায়েল করতে গুলিবর্ষণে পারদর্শী হলেও নিজ দেশের সাধারণ মানুষকে হত্যা করতে মোটেও প্রস্তুত নয়। সেনাবাহিনীকে সেভাবে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় না। সেনাবাহিনীর সদস্যরা কাকে গুলি করবে? যারা আন্দোলন করছেন, তারা কারা? ওরা তো আমাদের ভাই, আমাদেরই বোন। কাজেই কে কার বুকে গুলি ছুড়বে? এ নৈতিক প্রশ্নগুলো সেনাসদস্যদের মনে সব সময়ই উদিত হয়। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে বলা প্রয়োজন। সেনাবাহিনীতে সাধারণত একবারে মাঠ পর্যায়ে জুনিয়র কর্মকর্তারা সৈনিক নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। লেফটেন্যান্ট, ক্যাপ্টেনরা সাধারণত এ সৈনিকদের কমান্ডার হয়ে থাকেন। এবারের আন্দোলনে যেসব শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের অনেক ক্লাসফ্রেন্ডই সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ও ক্যাপ্টেন পদবিতে কর্মরত আছেন। এ কারণে জুনিয়র কর্মকর্তারা দেশের চলমান আন্দোলনকে খুব গভীরভাবেই পর্যবেক্ষণ করে আসছিলেন। আমি এমন একজন ক্যাপ্টেনকে জানি, যার ছয়জন ক্লাসফ্রেন্ডকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। এবার বুঝুন সেই কর্মকর্তার মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে। এমন অনেক জুনিয়র সামরিক কর্মকর্তার বন্ধুরা এ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। কাজেই এসব কর্মকর্তার মন ও মানসিকতা একটি ন্যায়সংগত আন্দোলনের পক্ষে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
এরপরও কথা আছে; সেনাবাহিনীর নিু পদবির সৈনিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করেন। ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা তাদের কর্মকাণ্ড দ্বারা দেশব্যাপী যে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে ভোগের রাজনীতি করেছেন, খোঁজ নিলে জানা যাবে, তাতে দেশের অনেকেই তাদের অত্যাচারের শিকার হয়েছেন। সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যও তাদের হাত থেকে রেহাই পাননি। নিজ পরিবার কিংবা আত্মীয়স্বজন অনেকেই কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগ কিংবা তাদের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং যুবলীগের সন্ত্রাসী হামলার শিকার। এতকিছুর পরও একজন কর্তৃত্ববাদী সরকারপ্রধান ও দলকে অন্যায়ভাবে টিকিয়ে রাখতে যেভাবে মানুষ হত্যা করা হয়েছে যে, এমন একটি ন্যক্কারজনক পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী কোনো অবস্থাতেই এ হত্যাকাণ্ডের অংশীজন হতে চায়নি।
দেশব্যাপী সেনাবাহিনী নিয়োগ করার পর আন্দোলনের পরিস্থিতি মূল্যায়ন ও ফিডব্যাক নিতে গত ৩ আগস্ট সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার সেনা সদরে বিভিন্ন স্তরের সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। দেশের অন্যান্য ফরমেশনের কর্মকর্তারাও ভার্চুয়ালি ওই মতবিনিময় সভায় যুক্ত ছিলেন। মতবিনিময়কালে অনেকেই এ আন্দোলন দমনে যে কোনো নেতিবাচক ভূমিকা সেনাবাহিনীর জন্য বদনাম বয়ে আনবে বলে মতপ্রকাশ করেন। সেনাপ্রধান সামরিক কর্মকর্তাদের মনোভাবের কথা উপলব্ধি করে সিদ্ধান্ত নেন, যে কোনো উসকানিতেও সেনাবাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করবে না। শুধু তাই নয়, শিক্ষার্থীদের মিছিলকে সেনাসদস্যরা কোনো ধরনের প্রতিহত কিংবা বাধা দেবে না। মিছিল চলাকালে সেনাসদস্যরা বরং সরে গিয়ে জায়গা করে দেবে। এ খবর যখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন আন্দোলনের মোড়ই ঘুরে যায়। খুব দ্রুত পট পরিবর্তন হতে থাকে। এছাড়া ৪ আগস্ট আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে রাওয়া ক্লাবে। সেদিন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতি একযোগে সংহতি প্রকাশ করেন। এ খবর দ্রুত দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এটিও সেদিন সেনাবাহিনীতে কর্মরত সব শ্রেণির সদস্যদের কাছে দেশ ও জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করেছিল। বিক্ষোভকারীদের ওপর সেনাবাহিনী গুলি করবে না, শেখ হাসিনা এ সিদ্ধান্তে খুশি হতে পারেননি। তিনি চেয়েছিলেন, পুলিশের পাশাপাশি সেনাসদস্যরাও আন্দোলন দমনে যা কিছু প্রয়োজন, তাই করবে। তাতে আরও বেশি রক্তপাত হতো; এ কথা বিবেচনা করে সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে তাদের অপারগতার কথা জানিয়ে দেন। এভাবেই সেনাবাহিনী সেদিন শেখ হাসিনা ও তার সরকারের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।