সব বাধাবিঘ্ন মাড়িয়ে সরকার নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে দেখেও অনেকে প্রশ্ন করছেন– ৭ জানুয়ারির নির্বাচনটি হচ্ছে তো? তারা এটাও বলার চেষ্টা করছেন, ঠিক কী কী কারণে এবার আগের মতো করে আরেকটি নির্বাচন সেরে ফেলা সম্ভব নয়। তাদের একাংশের অবশ্য সতর্ক মন্তব্য, নির্বাচনটি করে ফেলতে পারলেও তার ভিত্তিতে আগের মতো করে দেশ পরিচালনা করা যাবে না। তখন নতুনতর সংকটে জড়াতে হবে সরকারকে।
এ ক্ষেত্রে গোড়ার প্রশ্ন হলো, দেশে আদৌ কোনো ‘ইলেকশন’ হতে যাচ্ছে কিনা? নাকি এটা ‘সিলেকশন’? ইলেকশন বলতে কী বোঝায়, সেটা জনগণকে নতুন করে বোঝানোর কিছু নেই। ইলেকশন আর সিলেকশনের তফাতও তাদের জানা। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দল অংশ না নিলে নির্বাচনে কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রতিপক্ষ থাকে না। দল-মতে বিভক্ত ভোটারদের বেছে নেওয়ার সুযোগও থাকে না তখন। নির্বাচন তখন হয় ‘নিজেদের মধ্যে’। ইলেকশন পর্যবসিত হয় সিলেকশনে। এ দেশে অতীতেও এটা কমবেশি হয়েছে। শুধু সামরিক নয়; ‘গণতান্ত্রিক শাসনামলে’ও হয়েছে। দুই ক্ষেত্রেই শাসনের বৈধতা অর্জনে ব্যবহৃত হয়েছে এটি। বৈধতা মানে আইনগত বৈধতা। রাজনৈতিক ও নৈতিক বৈধতা নয়। সেটি অর্জনে ‘ইলেকশন’ করার কোনো বিকল্প নেই।
ইলেকশন বা নির্বাচনের আগে তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছু শব্দ জুড়ে দেওয়ায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। যেমন– সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ। এ তিনটি শব্দ আমাদের প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল এরশাদ শাসনামলে। তাঁর পতন ঘটিয়ে আমরা চাইছিলাম ওইসব বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নির্বাচন করে জনইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়ে সরকার গঠন করতে। গণতন্ত্রচর্চার নতুন পরিসরে যেতে। জনইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানো একাধিক নির্বাচন সম্পন্ন করতে আমরা সক্ষমও হয়েছিলাম। স্থানীয় নির্বাচনগুলোও তখন মোটামুটি গ্রহণযোগ্য পরিবেশে হতো। গণতন্ত্রচর্চায় মানের ক্রমাবনতিই অবশ্য দেখতে পাচ্ছিলাম। নির্বাচনের মানেও ঘটছিল অবনতি। সে ধারায় কী সব কাণ্ডকীর্তি হয়েছে এবং তার পথ ধরে ইলেকশন কীভাবে সিলেকশনে পর্যবসিত হয়েছে, সেটা সবারই জানা। এর দায় কার কতটা, তা নিয়ে হয়তো বিতর্ক হবে। কিন্তু জাতির এই দুর্ভাগ্য আড়াল করা যাবে না।
অনেকে হয়তো বলবেন, ভোটাররা তো ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। কোনো আসনেই যাতে ২০১৪ সালের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া কেউ জিততে না পারেন, তার ব্যবস্থা করছে সরকার। তারা এমনকি নিজ দল থেকে স্বতন্ত্র ও ডামি প্রার্থী রাখার ব্যবস্থা করছে। জোটসঙ্গী, দীর্ঘদিনের মিত্র আর সমমনা দলগুলোর প্রার্থীও থাকবে। তাদের ভেতর থেকে একজনকে বেছে নেওয়ার সুযোগ পাবেন ভোটাররা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দল-মত নির্বিশেষে সবাই জানে– নির্বাচনে বিরোধী দল নেই। ক্ষমতাসীনদের চ্যালেঞ্জ করতে পারে, এমন কোনো দল নেই। তাই নির্বাচনের অপরিহার্য শর্ত ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা’; তার সুযোগ নেই। কারা এতে জয়ী হতে চলেছেন, সেটা আগে থেকেই জানা। সে দলটি আরও কিছু দল সঙ্গে নিয়ে আসন ভাগাভাগির একটা নির্বাচনই করতে চলেছে। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগে তা নিয়ে জোটসঙ্গী, মিত্র আর সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনাও চলছে তার। চক্ষুলজ্জায় সেটা আবার অস্বীকারেরও চেষ্টা চলছে। চক্ষুলজ্জার কিছুটা অবশিষ্ট আছে তাহলে!