দেশ রূপান্তর : একদিকে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলগুলোর অনড় অবস্থান, অন্যদিকে সংলাপের চাপের মধ্যেই ইসি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করল। সার্বিকভাবে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
আলী ইমাম মজুমদার : তফসিল ঘোষণার পরে নির্বাচন সামনে রেখে মানুষের যেভাবে এটা নিয়ে উল্লসিত হওয়ার কথা ছিল আমি তেমনটা দেখছি না। একটা স্থবিরতা দেখা যাচ্ছে। বরং মনে হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল একতরফা নির্বাচন করার আরেকটা সুযোগ পেল। এজন্য ক্ষমতাসীনদের অনেকটা ভারমুক্ত মনে হচ্ছে। কিন্তু ইন জেনারেল, আমরা যেটা ভাবি আর কি, নির্বাচনের মাধ্যমে একটা দেশে নতুন সরকার আসবে, হতে পারে আগের সরকারই নতুন ভাবে ফিরে এলো। এতে কোনো অসুবিধা নেই, কে আসবে সেটা বড় কথা নয়, কিন্তু জনগণের সমর্থন নিয়ে যদি আসে তাহলে তারা জনগণের প্রত্যাশার প্রতি অধিকতর সচেতন থাকেন এবং অধিকতর নজরদারিতে থাকেন। বর্তমান যে অস্থিরতা, সেটা একটা ভালো নির্বাচন হলে কেটে যেত। জনগণ কাদের চায়, সেটা ঠিক হয়ে যেত। বর্তমান ক্ষমতাসীনদেরই যদি জনগণ চায়, বিরোধীদেরও সেটা মেনে নিতে হবে। বিরোধীরা মুখে যাই বলুক না কেন, তেমন নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীনরাই জিতলে তারাও মেনে নিত। আগের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনগুলোও মেনে নিতে হয়েছে।
দেশ রূপান্তর : রাজনৈতিক সমঝোতার কথা তো আপনারা বলে আসছেনই। কিন্তু দেশের বড় তিন রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন নিয়ে শর্তহীন সংলাপে বসার মার্কিন চিঠির পরদিনই যে ইসি তফসিল ঘোষণা করল। যেখানে ধারণা করা হচ্ছিল আরও কয়েকদিন পর এই ঘোষণা আসবে। এখানে কি কোনো তাড়াহুড়া দেখতে পান?
আলী ইমাম মজুমদার : না, আমি মনে করি না যে তারা কারোর দ্বারা তেমন প্রভাবিত হয়েছেন। তবে তফসিল ঘোষণার সময়টা তারা যথাযথভাবে নেননি। এমনকি প্রধান নির্বাচন কমিশনার তফসিল ঘোষণার যে ভাষণ দিয়েছে জাতির উদ্দেশে, সেখানেও তিনি কিন্তু দেশের রাজনৈতিক অবস্থা যে অস্থিতিশীল সেই ইঙ্গিত তার ভাষায় দিয়েছেন। ভাষণে সিইসি আশঙ্কা প্রকাশ করে চলমান সংকট কাটাতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজার তাগিদ দিয়েছেন। এখানে যদি বোঝাপড়া, সমঝোতা থাকলে, অথবা পরিস্থিতি ভালো থাকলে তো তার এ কথা বলা লাগে না। তো এই অসম্পূর্ণ পরিস্থিতিতে তিনি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেন।
দেশ রূপান্তর : নির্বাচন কমিশন কি আস্থা অর্জনে যথেষ্ট তৎপর ছিল?
আলী ইমাম মজুমদার : শুধু তফসিল ঘোষণা না, আমি সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করব। বর্তমান ইসি তো দুই বছর সময় পেয়েছে। যেটা সবার স্বাভাবিক প্রত্যাশা থাকে নির্বাচনে একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের। আপনি যখন কোনো খেলায় অংশ নেবেন বা দল নিয়ে যাবেন, আপনার প্রত্যাশা থাকবে যে বা যিনি রেফারি কিংবা আম্পায়ারিং করবেন তিনি যে কেবল নিরপেক্ষ হবেন তাই-ই না, তিনি তার সিদ্ধান্ত মানানোর ক্ষমতাও রাখবেন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে বর্তমানে মাঠে যে বিরোধী দলগুলো আছে তারা এই আস্থাটা রাখতে পারছে না। এখন পর্যন্ত বিরোধী দলগুলোকে আস্থার জায়গায় আনা যায়নি। এই কমিশন তার দুই বছর সময়কালে তাদের সেই আস্থার জায়গায় আনতে পারেনি যে নির্বাচনে অংশ নিলে বিরোধীরা ফেয়ার প্লের সুযোগ পাবে। ২০১৮-তে যেমন তারা অংশ নিয়েছিল। ওই নির্বাচন কিন্তু অংশগ্রহণমূলক ছিল। তবে ওই নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক জনশ্রুতি আছে যে ভোটার না এমন অন্য কেউ অধিকাংশ ভোট দিয়ে গেছে। এখন ১৬ আনা ভোট না দিক অন্তত ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ ভোট যদি অন্যরা দেয়, যেখানে ভোটকেন্দ্রেও ভোটার উপস্থিতি খুবই কম ছিল। বিশেষ করে তখন বিরোধী দলের যেসব বড় বড় নেতা ছিলেন তারা কিন্তু ভোটের আগেই অভিযোগ করছিলেন যে তাদের বাড়ি থেকে বেরই হতে দেওয়া হচ্ছে না। এ কথা প্রয়াত বিএনপি নেতা মওদুদ আহমেদ সাহেব বলেছিলেন এবং মেজর হাফিজ কয়েকদিন আগেও ওই নির্বাচন নিয়ে একই অভিযোগ জানিয়েছেন। এ জাতীয় অভিযোগ আরও বেশ কয়েকজন করেছিলেন। আমি উত্তরাতে বসবাস করি, আমার ঘরের কাছেই গাজীপুর জেলা। এখানে আমরা যেটা শুনেছি এবং দেখেছি ও যেটা পত্রপত্রিকায়ও এসেছে, বিশেষ করে পোলিং এজেন্টদের কথা যদি ধরেন। সরকারের বিপক্ষ দলের যারা পোলিং এজেন্ট ছিল, তারা এবং বিরোধীদের মধ্যে যারা নেতৃস্থানীয় তারা কেউ মাঠে থাকতে পারেনি। এখন নির্বাচনে আপনার পক্ষে কেবল সমর্থক থাকলেই তো হবে না, সমর্থকদের সংগঠিত করা ছাড়াও সংগঠন বা দলের কিছু কাজ থাকে, তাদের কিছু ব্যাপার আছে। তো সেই সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় যারা ভূমিকা রাখবেন তাদের কাউকে কাউকে বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে অথবা কাউকে কাউকে জেলাছাড়া করা হয়েছে। বিরোধী দল ভোটকেন্দ্রে এজেন্টও দিতে পারেনি।