জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তন কী হলো?
সাঈদ ফেরদৌস: এই গণ-অভ্যুত্থানের কয়েক দিন আগেও মনে হতো, শেখ হাসিনার সরকার বোধ হয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাঁকে সরানো গেছে। আন্দোলনের পেছনে তো জনগণের বিরাট আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নটা হলো আমরা এ রকম দেশ চাই না, আমরা এ রকম ভয়াবহ দুর্নীতি, নজিরবিহীন নিপীড়ন ও কণ্ঠরোধ আর দেখতে চাই না।
অনেকে অনেক রকমভাবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করবেন। কেউ বলবেন স্বপ্ন অধরা রয়ে গেছে, কেউ বলবেন স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। আসলে গণ-অভ্যুত্থানের পর কী ঘটতে পারে, তা আমাদের অভিজ্ঞতায় ছিল না। আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গেও ৫ আগস্টকে মেলানো যাবে না। তখন এত মানুষ মরেনি, এত লোক রাস্তায়ও নামেনি।
পাঁচ সপ্তাহের ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করলে আমরা হতবাক হয়ে যাই। একজন শাসক তাঁর জনগোষ্ঠীর ওপর কীভাবে এ কম হত্যা-নির্যাতন চালাতে পারে? এরশাদের সময়ে আন্দোলনের অন্যতম চালিকা শক্তি ছিল সমাজের সেই অংশ, আমরা যাঁদের বিবেক, অগ্রবর্তী ও প্রগতিশীল অংশ মনে করি; এবার কিন্তু তাঁরা ছিলেন না। বরং আমরা যাঁদের পশ্চাৎপদ অংশ ভাবতাম, তাঁরাই মূল ভূমিকা পালন করেছেন।
পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম।
সাঈদ ফেরদৌস: ৫ তারিখে যখন শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেন এবং আমরা বিজয় উৎসব করছি, তখনো জানি না ওই দিনও কত মানুষ মারা গেছে। তত্ত্বীয়ভাবে আমরা জানি, স্বৈরশাসকের কবলে পড়লে একটা দেশের অর্থনীতি, প্রশাসন, বিচার বিভাগ—সবকিছু তছনছ হয়ে যায়। কিন্তু তার গভীরতা উপলব্ধি করতে পারি না। রাষ্ট্রযন্ত্রের সবখানে ঘুণ ধরে গেছে। যাঁরা হাসিনার পতন ঘটালেন, তাঁরাই তো ১৫ বছর তাঁর শাসনের অধীন বসবাস করেছেন। ফলে এই সময়ে তো বাংলাদেশের মানুষ আপস করতে শিখেছে। এই বাস্তবতায় বিশাল পরিবর্তন ঘটবে, এমন আশা আমরা কী করে করি।
ভিন্ন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এবার বিজয় দিবস উদ্যাপিত হচ্ছে। এর ভিন্ন তাৎপর্য আছে বলে মনে করেন?
সাঈদ ফেরদৌস: আওয়ামী লীগ ১৫ বছরের শাসনে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় দিবসকে তাদের ক্ষমতার পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে হাস্যকর অভিধায় পরিণত করেছে। তারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের সোল এজেন্সি দাবি করেছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ ছিল, যাতে দলমত-নির্বিশেষে সমগ্র জাতি অংশ নিয়েছে। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে দলীয় যুদ্ধে ও ব্যবসার উপাদানে পরিণত করেছে।
বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার হওয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেটাও হাস্যকর করে তুলল। যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চে তো আমরাও ছিলাম। যতই দিন যেতে লাগল, এটাকেও তারা দলীয়করণ করে ফেলল। আওয়ামী লীগ এটাকে যখন বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তখনই ব্যাপারটা শেষ হয়ে গেল।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এই যে প্রবঞ্চনা, তার অবসান ঘটল ৫ আগস্ট। সেই কারণেই এই বিজয় দিবস নতুন স্বপ্ন ও নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের প্রত্যয় নিয়ে হাজির হলো।
১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪ সালের মধ্যে যোগসূত্র বা ভিন্নতাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
সাঈদ ফেরদৌস: এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সাধারণত এই ফ্রেম থেকে দেখানো হয় যে সাতচল্লিশ ও একাত্তর পরস্পরের অ্যান্টিথিসিস। সাতচল্লিশকে মনে করা হয় পাকিস্তানের মধ্যে ঢুকে যাওয়া। কিন্তু আমরা বলতে চাই, সাতচল্লিশও মুক্তির লড়াই ছিল। কিন্তু সাতচল্লিশের পর বায়ান্ন, উনসত্তর অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। বাংলাদেশের মানুষ মুসলিম লীগকে সাত বছরের মধ্যে ছুড়ে ফেল দিয়েছে। কিন্তু সাতচল্লিশ তো বাঙালি মুসলমানদের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছিল—শ্রেণি হিসেবে তার বিকাশ, চাকরির সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি, হিন্দু সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে আসা। আমরা সেই সত্যকে এত দিন স্বীকার করিনি।
আমাদের মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ও সমাজে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমরা যাদের সমাজের প্রগতিশীল ও অগ্রসর শ্রেণি মনে করেছি, তারা একে অস্বীকার করেছে। কিন্তু সমাজের বৃহত্তর অংশ তো তা মনে করে না। আমরা মনে করেছি ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে যে বৃহত্তর জাতীয়তাবাদ গড়ে তুলেছি, এটাই শুভ। কিন্তু আমরা তো সমাজের বৃহত্তর অংশকে সেখানে নিয়ে আসতে পারেনি। ভারত ও পাকিস্তানের দিকে তাকান, শ্রীলঙ্কায়ও ধর্মের আধিপত্য প্রবল।