বেশ কয়েক বছর আগের ঘটনা। চাঁদপুরের মতলব উপজেলার একটি গ্রামে গেছি বেড়াতে। ঘুরতে ঘুরতে এক আত্মীয়ের বাড়ির উঠানে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে চোখ আটকে যায়। মুসলিম বাড়ির আঙিনায় বাঁধানো তুলসীতলা। জানতে চাইলে বাড়ির একজন জানান, পাশের হিন্দু প্রতিবেশীদের বাড়িতে তুলসীগাছ লাগানোর মতো জায়গা নেই। তাই এই বাড়ির কর্তা নিজের আঙিনায় তুলসীতলা করে দিয়েছেন। গৃহকর্তা নিজে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, হজ করে এসেছেন কয়েক বছর আগে। ভিন্নধর্মের মানুষকে নিজ বাড়িতে ধর্মচর্চার অধিকার দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হননি তিনি।
বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে এমন সম্প্রীতির উদাহরণ কম নয়। তার কারণ সম্ভবত এখানকার জনবিন্যাস, ভৌগোলিক অবস্থান ও কৃষিভিত্তিক সমাজ। বিপরীতে আমাদের সমাজে অসহিষ্ণুতার চিত্রও যে খুঁজে পাওয়া যাবে না তা নয়, তবে সহিষ্ণুতাই সেখানে প্রাধান্য ছিল। তবে দিন দিন অসহিষ্ণুতা বেড়েই চলেছে আমাদের সমাজে।
মূলত অসাম্য যত বাড়ছে, মানুষের চোখ ঘোরাতে ততই ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষ উসকে দেওয়া হচ্ছে। লুটপাট, অভিজাততন্ত্রের উত্থান, ব্যাপক ধনবৈষম্য আর বিচারহীনতার জন্ম দিয়েছেন বিগত দিনের তথাকথিত ‘উদার নৈতিকতাবাদী’ শাসকেরা। তাঁদের হাত ধরেই রাষ্ট্র দমন–পীড়নের যন্ত্র হয়ে উঠেছে। আর এর প্রতিক্রিয়ায় আরও অসহিষ্ণুতার জন্ম। তাই চাঁদপুরের অভিজ্ঞতার বিপরীত চিত্রও আমরা দেখি।
আজ আন্তর্জাতিক সহিষ্ণুতা বা সহনশীলতা দিবসে। অসহিষ্ণুতার বিপদ সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কো এ দিবসটির ঘোষণা দেয়। প্রতি বছর ১৬ নভেম্বর এ দিবস পালন করা হয়।
আজকের দিন ঝুমুর কান্তি বাউলের কথা মনে পড়ে। এ বছরের ৬ জুন নিজ বাড়ি নরসিংদী থেকে কর্মক্ষেত্র ঢাকায় আসার জন্য ট্রেনে চেপেছিলেন তিনি। আগে থেকেই অসুস্থ ঝুমুর একটু বাতাসের জন্য দাঁড়ান জানালার পাশে। আর তা নিয়ে আপত্তি অন্য এক যাত্রীর। তার জের ধরে ঝুমুরকে তিনি বেধড়ক কিলঘুষি মারতে থাকেন। একপর্যায়ে ঝুমুর মেঝেতে লুটিয়ে পড়লে অন্য যাত্রীরা হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তাঁর মৃত্যু হয়।
কোন দোষে ঝুমুরকে মরতে হলো—এমন প্রশ্ন তাঁর পরিবারের। এ হত্যার পেছনে কোনো দীর্ঘ পরিকল্পনা, বিদ্বেষ বা পূর্বশত্রুতা নেই। তবে যোগ রয়েছে অসহিষ্ণুতার। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে আমরা বারবার এমন ঘটনা দেখেছি। জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সরকারের বিদায়ে মানুষের স্বপ্ন ছিল একটা সহিষ্ণু সমাজের। কিন্তু ৫ আগস্টের পর দেশের মানুষ পরিচিত হলো ‘মব জাস্টিস’ ও ‘মব ভায়োলেন্স’ নামের দুটি নতুন শব্দের সঙ্গে।
নতুন ঘটনা হলো, এতকাল ধরে ‘উদার গণতন্ত্রীরা’ সমাজ থেকে রক্ষণশীলদের উৎখাত যেমন চেয়েছে, তেমনি এখন রক্ষণশীলেরা ‘উদার গণতান্ত্রিকদের’ দমন করতে চায়। সুতরাং ফ্যাসিবাদ বিদায় হয়েছে বলে আলগা স্বস্তি পাওয়ার পথ আপাতত বন্ধ বলেই অনেকের ধারণা। এর থেকে যে মুক্তির উপায় খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। এ জন্য প্রথমে উচিত ঘটমান বাস্তবতা স্বীকার করে নেওয়া। এরপর কেন এমন হলো, বারবারই সে প্রশ্ন করতে হবে।
আবার আসি ঝুমুর কান্তি বাউলের কথায়। মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার বাড়ি বদলে ফেলেছিল তাঁর স্মৃতি সেখানে ছড়িয়ে আছে বলে। নতুন বাড়িতে এসেও স্বস্তিতে নেই তারা। ৬ জুলাই এ নিয়ে প্রথম আলোয় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ঝুমুরের ছোট বোন স্নিগ্ধা বাউল আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘নতুন বাসাটিও আবার পাল্টাতে হবে। এই বাসার মালিক ১০ বছর বয়সী পৌলমীর কাছে জানতে চান, তার বাবা কীভাবে মারা গেছেন? বাবাকে হারিয়ে এমনিতে সে অনেকটা চুপচাপ হয়ে গেছে। কিন্তু এ ধরনের প্রশ্নে সে ঘাবড়ে গেছে। বাসার মালিক তো এ প্রশ্ন বড়দের কাছেও করতে পারতেন। স্কুলেও বাচ্চারা পৌলমীর কাছে তার বাবা সম্পর্কে জানতে চায়। সব মিলে আমরা খুব খারাপ পরিস্থিতিতে আছি।’
আসলে কেবল ঝুমুরের পরিবার নয়, খুব খারাপ পরিস্থিতিতে আছে এ দেশের ধর্মীয়, জাতিগত, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের দিক থেকে সংখ্যালঘু মানুষ। দেশে ক্ষমতার পটপরিবর্তের বহু আগে থেকেই এ সংস্কৃতি চলছে। নতুন বাংলাদেশেও যে এই অস্বস্তি কমেনি, তা খবরের কাগজে চোখ রাখলেই স্পষ্ট হয়।