বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ ছিল, তারা নাগরিককে তাঁর সংবিধানপ্রদত্ত বাক্স্বাধীনতার অধিকার থেকে বঞ্চিত রেখেছে; অর্থাৎ নাগরিকেরা তাঁদের চিন্তা, বিবেক ও যুক্তিতে যে বিষয়গুলো মন্দ তার অনেক কিছুই বলতে বা লিখতে পারতেন না; বিশেষ করে যেসব জায়গায় রাজনৈতিক ভিন্নমত বা ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার ব্যাপার ছিল। সরকার, সরকারি দলের জনপ্রতিনিধি এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও কথা বলা বা লেখার ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছিল। সেটি গণমাধ্যম তো বটেই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও।
তথ্যপ্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এবং পরে সাইবার নিরাপত্তা আইনের বিভিন্ন ধারার মাধ্যমে নাগরিকের বাক্স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে—যার মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্ষমতাকে ‘আনচ্যালেঞ্জড’ রাখা। ফলে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনটি যে পরে একটি রাজনৈতিক আন্দোলন তথা সরকার পতনের এক দফা দাবিতে পরিণত হলো এবং সেখানে শিক্ষার্থী ও সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরেও বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ যে যুক্ত হলেন, তার পেছনে কথা বলতে না পারার এই ক্ষোভকে একটি বড় কারণ বলে মনে করা হয়।
এ রকম বাস্তবতায় গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, যেমন ফেসবুকে অনেকেই বাক্স্বাধীনতার প্রসঙ্গ টেনে লিখেছেন, এত দিন বলতে পারেননি, এখন বলছেন।
প্রশ্ন হলো কী বলছেন? বাক্স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? কেননা, এখনো অনেক ফেসবুক পোস্টের নিচে, বিশেষ করে সমসাময়িক রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলন প্রসঙ্গে কেউ কিছু লিখলে তার নিচে ঘৃণা, বিদ্বেষ ও প্রতিশোধপরায়ণমূলক অসংখ্য মন্তব্য চোখে পড়ে। তার মানে সবাই চায় দুনিয়ার সবাই তার মতো করে বলবে ও লিখবে। না হলেই সে প্রতিপক্ষ, শত্রু। তার মানে সে বাক্স্বাধীনতা চায় শুধু নিজের জন্য; অন্যের জন্য নয়।
বিষয়টা কি এমন যে এত দিন যারা সরকারের বা সরকারি দলের সমালোচনা করতে পারেননি কিংবা সমালোচনা করলে নানাবিধ হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা ছিল, তাঁরা সুযোগ পেয়েছেন বলে এখন প্রতিপক্ষকে যা খুশি বলবেন? তাঁদের প্রতি ঘৃণা ছড়াবেন?
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ফেসবুকে কেউ সরকার বা সরকারি দলের সমালোচনামূলক কোনো পোস্ট দিলে তাঁকে ‘বিএনপি-জামায়াত’ ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া হতো। এই ট্যাগিংয়ের ভয়ে যাঁরা সত্যিই কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক নন, তাঁরা যেকোনো কিছু লেখার আগে দশবার ভাবতেন। অনেকে পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগের সমর্থক বা নৌকার ভোটার—এমনও অনেকে সরকারের নানা কাজ যেমন প্রকল্পের নামে দুর্নীতি, ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নির্যাতন ইত্যাদির সমালোচনা করেও ‘বিএনপি-জামায়াত’ ট্যাগিংয়ের শিকার হয়েছেন। ফেসবুকে কোনো মন্ত্রী, এমপি, মেয়রের সমালোচনা করে বা তাঁদের সম্পর্কে তির্যক মন্তব্য করে জেল খেটেছেন, চাকরি হারিয়েছেন—এ সংখ্যা অনেক। এখন আবার যদি সেই একই প্রক্রিয়ায় ঘৃণার বিপরীতে কাউন্টার ঘৃণা ছড়ানো হয় এবং যাঁরা এত দিন কথা বলতে বা লিখতে পারেননি বলে দাবি করছেন, তাঁরা যদি তাঁদের মতের বিপরীতে গেলেই আক্রমণাত্মক কথা বলেন—তাহলে আর পরিস্থিতির কী পরিবর্তন হলো?
যে আন্দোলনটি গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিল, তার মূল উদ্দেশ্য যদি হয় ‘রাষ্ট্র সংস্কার’, তাহলে কাউন্টার ঘৃণা দিয়ে সেই রাষ্ট্র সংস্কার আদৌ সম্ভব কি না—সেটি ভেবে দেখতে হবে। নিজের মতের বিরুদ্ধে গেলেই তিনি প্রতিপক্ষ বা শত্রু—এই অগণতান্ত্রিক ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে যে বিপজ্জনক প্রবণতাটি লক্ষ করা যাচ্ছে সেটি হলো, কেউ যদি চুপ থাকতে চান, তাঁকেও আক্রমণ করা হচ্ছে এই বলে যে আপনি চুপ করে আছেন কেন? বিশেষ করে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে কারা তাঁদের ফেসবুক প্রোফাইল লাল করেছেন আর কারা কালো—সেটি দিয়েও এখন পক্ষ-বিপক্ষ বিবেচনা করা হচ্ছে। যাঁরা প্রোফাইল লাল করেছেন, ধরে নেওয়া হচ্ছে তাঁরা আন্দোলনের পক্ষের লোক। আর যাঁরা সরকারের শোক দিবস পালনের আহ্বানে প্রোফাইল কালো করেছেন, তাঁরা আন্দোলনের বিপক্ষে তথা ‘সরকার বা আওয়ামী লীগের দালাল’।