বান্দরবানের লামা উপজেলার নানা পাহাড়ে দীর্ঘদিন ধরে জুমের জমিন এবং পাহাড়ি বাস্তুতন্ত্র জবরদখল করে রাবার বাগান করার জন্য তৎপর নানা কোম্পানি। এমনি এক পাহাড়ের ম্রো নাম সরই হুং (সরই পাহাড়)। সরই হুংয়ের প্রায় ৪০০ একর পাহাড়ি বনাঞ্চল ও জুমজমিন দখল করে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানি। পাহাড়ের ম্রো ও ত্রিপুরা আদিবাসীদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় এই কোম্পানি। আদিবাসীরা যাতে এলাকা থেকে উচ্ছেদ হয়ে যায় ঝিরির পানিতে বিষ দেয়। পৃথিবীর প্রাচীন এক পত্রঝরা শালবন মধুপুর। ১৯৫০ সাল থেকে রাষ্ট্র এই বনের সঙ্গে অন্যায় করছে। বনবিভাগ দেওয়াল তুলে বনকে বন্দি করতে চেয়েছে। মান্দি-কোচ আদিবাসীরা বন বাঁচাতে লড়াই করেছে। পুলিশ ও বনবিভাগের গুলিতে শহীদ হন পীরেন স্নাল। ভূমি দখলের জন্য লন্ডভন্ড করে দেওয়া হয় নওগাঁর ভীমপুর। জমি বাঁচাতে শহীদ হন আলফ্রেড সরেন। পাহাড় থেকে অপহরণ করা হয় কল্পনা চাকমাকে। ঝরা শালপাতা কুড়ানোর জন্য গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয় শিশিলিয়া স্নালের শরীর। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে সাঁওতালদের জমি জোর করে অধিগ্রহণ করে চিনিকল। ভূমি রক্ষার আন্দোলনে শহীদ হন শ্যামল হেমব্রম, রমেশ টুডু ও মঙ্গল মার্ডী। রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে সেচের পানি না পেয়ে আত্মহত্যা করেন অভিনাথ ও রবি মার্ডী।
মৌলভীবাজারে নাহার, বনাখলা, আগর, কাঁকড়াছড়া, ঝিমাই খাসিপুঞ্জির পানজুম ও বাগান ধ্বংস করে চাবাগান। কেবল ভূমিদখল, উচ্ছেদ বা নিপীড়ন নয়; আদিবাসীদের নিয়ে রাষ্ট্রের উপস্থাপন প্রবলভাবে বর্ণবাদী এবং ঔপনিবেশিক। পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে জাদুঘর কিংবা তথাকথিত সৃজনশীল শিল্পমাধ্যমে আদিবাসী জীবন ও ইতিহাসকে ‘নিষ্ক্রিয় অবজেক্ট’ এবং ‘অপর’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। সাঁওতালদের প্রধান খাদ্য ‘ভাত, পিঁপড়া ও মদ’ লেখার ভেতর দিয়ে রাষ্ট্র আগ্রাসী স্বাদ পায়। উন্নয়ন, আগ্রাসী গাছের বাগান, বাণিজ্যিক পর্যটন, বিনোদনকেন্দ্র, জলপাই বাহাদুরি, ইকোপার্ক, বহুজাতিক খননের নামে আদিবাসী বসতি ও জীবন বারবার ছিন্নভিন্ন হয়। রাষ্ট্র আদিবাসী হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়ন, হামলা ও ভূমিদখলের কোনো বিচার করেনি। আদিবাসীদের সামনে রাষ্ট্র কর্তৃত্ববাদী বাঙালি জাতীয়তাবাদ জারি রেখেছে। এমনকি আদিবাসীরা নিজের নামে নিজেদের ডাকতে পারেন না। রাষ্ট্র না করেছে বারবার। গণমাধ্যমে চিঠি পাঠিয়ে নিষেধ করেছে। বৈষম্যমূলক পরিচয় নির্ধারণ করে রাষ্ট্র আদিবাসীদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। জুলাই গনঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করেছে। বৈষম্যহীন এক রাষ্ট্র রূপান্তরের কথা বলা হচ্ছে এখন। ফ্যাসিবাদী খবরদারিতে আদিবাসী জনগণকে ‘বাঙালি কর্তৃত্ববাদ’ সামাল দিতে হয়। রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদকে যারা প্রশ্ন করেন তারাও অধিকাংশ সময়ে আদিবাসী আয়নাতে নিজের চেহারা দেখতে ভুলে যান। রাষ্ট্রকে আদিবাসীমুখী হিসেবে সংস্কার করতে হবে। আদিবাসী জীবনের অমীমাংসিত জিজ্ঞাসাগুলোর মীমাংসা থেকেই রাষ্ট্রের রূপান্তর ঘটবে। গণঅভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আদিবাসী জনগণের প্রত্যাশা অনেক। সম্মানিত প্রধান উপদেষ্টাসহ প্রায় বহু উপদেষ্টাই আদিবাসী জনগণের ন্যায়বিচারে সক্রিয় ছিলেন। উপদেষ্টাদের অনেকেই আদিবাসীদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। নিজেরা সর্বদা ‘আদিবাসী’ শব্দটিই ব্যবহার করেছেন। আমরা চাই আদিবাসী জীবনে ঘটে যাওয়া ও ঘটমান সকল অমীমাংসিত অন্যায়ের মীমাংসায় ভূমিকা রাখবেন সরকারের এই উপদেষ্টারা।
কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা কেন আদিবাসী পরিচয়কে মানতে নারাজ? এ বিষয়ে এখনো রাষ্ট্রের কোনো বিশদ ব্যাখা বিশ্লেষণ আমরা শুনিনি। অধিপতি রাষ্ট্রের এই আচরণ বৈষম্যমূলক, তবে সর্বোপরি ‘অসাংবিধানিক’ নয়। কারণ রাষ্ট্রের সংবিধান আদিবাসী আত্মপরিচয় অস্বীকার করে। এমনকি সংবিধানে নেই এমন পরিচয় রাষ্ট্র তার প্রকল্প, প্রতিষ্ঠানের নাম এবং কর্মসূচিতে বহাল রাখে। বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে উল্লেখ আছে, ...রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। সংবিধানে ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়টি নেই। এমনকি সংবিধানে ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ প্রত্যয়টিও নেই। সংবিধানে আছে ‘নৃগোষ্ঠী’, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ নয়। কিন্তু সরকারিভাবে বহুল ব্যবহৃত প্রত্যয়টিই হলো ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’। এমনকি এই নামে একটি রাষ্ট্রীয় আইন, বহু সরকারি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প রয়েছে। ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০’ অনুযায়ী ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী’ বলতে ওই আইনের তফসিলে উল্লিখিত বিভিন্ন আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও শ্রেণির জনগণকে বোঝানো হয়েছে। জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০-এর একটি অন্যতম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো ‘দেশের আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সংস্কৃতি ও ভাষার বিকাশ ঘটানো’। বহু নথি, কর্মসূচি, বক্তব্য, ঘোষণা ও দলিলে ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়টি উচ্চারিত ও ব্যবহৃত হয়ে আসলেও রাষ্ট্রের তরফ থেকে নানা সময় ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়খানি ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা এসেছে।
আদিবাসী অধ্যুষিত মধুপুর শালবনে সংবিধান রচিত হলেও আদিবাসী আত্মপরিচয়কে আড়াল করে সংবিধানে সকলের পরিচয় নির্ধারিত হয় ‘বাঙালি’। ১৯৭২ সালে তৎকালীন সংসদ সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা এর প্রতিবাদ জানান এবং সংসদ বর্জন করেন। ২০০৫ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ অনুবিভাগ থেকে জানানো হয় দেশে কোনো আদিবাসী নেই। বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পার্বত্য চট্রগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠানো ১৯ এপ্রিল ২০০৬ তারিখের চিঠিতে আদিবাসী শব্দটির পরিবর্তে ‘উপজাতি’ লেখার নির্দেশ দেওয়া হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ২০০৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায়, দেশে উপজাতি আছে কিন্তু আদিবাসী নেই। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি ‘আদিবাসী’ সম্বোধন না করার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। ২০১৪ সালের ৭ অগাস্ট তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে প্রেরিত এক বার্তায় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুযায়ী দেশের আদিবাসী জনগণকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে পরিচয় না দেওয়ার কথা বলা হয়। ২০২২ সালের ১৯ জুলাই তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে টেলিভিশন টকশোতে আদিবাসী শব্দটি ব্যবহার না করার জন্য একটি নির্দেশনা জারি করা হয়। আদিবাসীরা কোনো জাতির ‘উপ’ নন, এমনকি নৃগোষ্ঠী বা জাতিসত্তা বলতে বাঙালিসহ আদিবাসীদেরও বোঝায়। তাহলে আদিবাসী আত্মপরিয়ের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ববাদ এক প্রবল বৈষম্য জারি রাখে। রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম দায়িত্ব হলো আদিবাসী আত্মপরিচয়কে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া। বাংলাদেশের আদিবাসী জনগণ একক আত্মপরিচয় হিসেবে ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়টি ব্যবহার করছে। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে যার নজির ও নথি আছে। জাতিসংঘ প্রদত্ত ‘ইনডিজেনাস পিপলস’-এর সংজ্ঞায়নের সঙ্গে ‘আদিবাসী’ প্রত্যয়ের মিল আছে। রাষ্ট্রকে আদিবাসী জনগণের আদিবাসী আত্মপরিচয়কে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। সংবিধানের ২৩ক ধারা সংশোধন করে লিখতে হবে, ...রাষ্ট্র আদিবাসী জনগণের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি, মাতৃভাষা, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং প্রথাগত সামাজিক আইনের অধিকার সুরক্ষা, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন’।