যা কিছু নতুন যুগের সূচনা করে তা–ই যুগান্তকারী। বিচার বিভাগের পৃথক্করণ যুগান্তকারী ঘটনা। বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সংবিধানের অসংশোধনীয় মৌলিক কাঠামোর অংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিভিন্ন রায়ে। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাস পাঁচ দশকের বেশি। এই দীর্ঘ সময় নানা ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে। ক্রমতালিকায় বিচার বিভাগের পৃথক্করণ কি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা? মোড় ঘোরানো অর্জন? উত্তর বোধ করি ইতিবাচক।
বিচার বিভাগের পৃথক্করণের আগে ও পরে মনোভঙ্গিতে ভালো রকমের পরিবর্তন আসার কথা। একান্নবর্তী থেকে আলাদা হওয়ার পর পরিবর্তন এসেছে কি? সেই বিচার অন্য কোথাও আলাপের জন্য তুলে রেখে শুধু এই কথাটিই বলা কর্তব্য যে—এ দেশের নাগরিকদের একটি জনগণের বিচার বিভাগ পাওয়া জরুরি। বিচার বিভাগের পৃথককরণ প্রসঙ্গ: মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ ও মূল ইংরেজি ভাষ্য বইটির আলোচনা নানা কারণে উপযুক্ত সময়। বইটি ভাষান্তর ও সম্পাদনা করেছেন মিল্লাত হোসেন।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, পৃথক্করণ—এগুলো নিছক আইন-আদালত আর বিচারকদের বিষয় নয়। বিচারকেরা কয় টাকা কম বা বেশি পেলেন কিংবা পেলেন না, এটা এ মামলার একেবারেই প্রান্তিক ও মামুলি বিষয়। সমগ্র দেশের প্রত্যেক নাগরিকেরই প্রতিদিনের ন্যায় পাওয়ার হিস্যা জড়িয়ে-পেঁচিয়ে আছে এ মামলায় আলোচিত ও মীমাংসিত বিষয়গুলোর সঙ্গে। নাগরিকের ন্যায়প্রাপ্তির পরম মাত্রার অধিকারের সংগ্রামে এই রায় অন্যতম যুদ্ধাস্ত্র। আর এই বই, রায়ের অনুবাদ যা রায়ের অন্তর্লগ্ন ভিত্তির মর্মোদ্ঘটক একটি প্রয়াস।
ইউপিএল দেশের একটি সম্ভ্রান্ত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান, যার প্রকাশনা–সৌকর্য আন্তর্জাতিক মানের। নিজেদের প্রকাশনাগত গুণমান ও শুদ্ধতা এই বইয়ের বেলায়ও বজায় রেখেছে। শুরুতেই একটি অসাধারণ মুখবন্ধ সংযোজিত করে বিষয়ের সঙ্গে সুবিচার করা হয়েছে বলে মনে করছি। কারণ, ড. রিদওয়ানুল হকের পাঠ অনুধ্যানের একটি বড় অংশ বিচারিক সক্রিয়তা, যা স্বাধীন বিচার বিভাগের অনিবার্য উপজাত।
এই রায়ের বাংলাকরণ সরকারের তরফ থেকেই করা উচিত ছিল। নিদেনপক্ষে, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের একটা উদ্যোগ প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু করতে হলো একান্তই ব্যক্তি উদ্যোগে। এ দফায় না হলে কবে হতো কে জানে। আদৌ হতো কি না, সেটাও প্রশ্ন! কারণ, সবচেয়ে দরকারি আইনগুলোরই অনুবাদ হয়নি। আমাদের অন্য কিছু সৃষ্টি করার মুরোদ না থাকুক অজুহাত দেওয়ার তুলনা নেই।
সংবিধানে সে সময়ই বাংলা পাঠ না থাকলে এত দিন হতো কি না সন্দেহ। রাষ্ট্রভাষা বাংলা ঘোষিত হয়েছিল ৫২ বছর আগে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই—বলে রক্ত দিয়েছিলেন সালাম-বরকতেরা ৭২ বছর আগে। কিন্তু সেই মায়ের ভাষায় দেশের আইন চর্চা কত দূর হলো, সে এক বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে আছে।
কাজের শুরুতে ভাবনা–বিন্দু থেকেই মানুষের মহাকাশযাত্রা কিংবা সূক্ষ্ম প্রোটনের গভীর গমন। শিল্পকর্ম সাহিত্য (অনুবাদ) কর্মও তা–ই। গাণিতিক প্রায়োগিক চর্চার ক্ষেত্রে বিন্দু একটি স্বতঃসিদ্ধান্ত, কিন্তু ধ্যানধারণার জগতে ও চিন্তা চর্চায়ও এই বিন্দু অভাবনীয় একটি সাধনার পরিসর তৈরি করে। এমন সাধনালব্ধ একটা প্রকল্প ছিল এই মহা অনুবাদযজ্ঞ, যেটি অনুবাদক ও লেখক তাঁর ভূমিকায় পরিষ্কার করেছেন।