২০২৪ সালের ‘আগস্টে’র প্রতিটি দিন যেন এক-একটা মাসের মতো দীর্ঘ। কত কিছু যে ঘটছে প্রতিদিন। উত্তেজনায় টগবগ করছে দেশ। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের পর এমন সময় আর আসেনি এ দেশে।
বাংলাদেশে একই সঙ্গে বিপুল চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে এবারের আগস্ট। সেই সব সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে ইতিমধ্যে ভাবুকেরা লিখছেন, বলছেন। পুরো দেশ এখন তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে মেতে আছে।
এর মাঝেই এল ‘১৫ আগস্ট’। আগে থেকেই এটা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক স্পর্শকাতর দিন। আলোচিত দিন। এবারের আগস্টে এই দিনকে ঘিরে মনোযোগ, আলোচনা ও উত্তেজনা আগের চেয়ে বেড়েছে।
এসব আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গ—কীভাবে আমরা দেখব তাঁকে, কীভাবে তাঁর জীবন ও মৃত্যুকে স্মরণ করব আমরা, ভবিষ্যতে তাঁকে কোথায় রাখব? এসব নিয়ে নতুন করে সমাজে বিতর্ক উঠেছে। আলোচনা-অনুমান হচ্ছে। সামনে এ রকম আলোচনা আরও হবে বলে মনে করছি।
বিতর্ক মানেই খারাপ নয়। ‘পাবলিক ফিগার’ বা জননেতাদের নিয়ে ইতিহাসে বিতর্ক থাকে। বিশ্বজুড়ে ইতিহাসবিদেরা এসবকে স্বাস্থ্যকর হিসেবেই দেখেন। অন্তত একটা উদাহরণ দিই। লেনিনকে পুঁজিবাদী বিশ্ব পছন্দ করছে না। বহু আগে তিনি মারাও গেছেন। সমাজতান্ত্রিক রাশিয়াও নেই। কিন্তু গত কয়েক বছর লেনিনকে নিয়ে পড়তে গিয়ে দেখেছি, খোদ আমেরিকায় তাঁকে নিয়ে শত শত একাডেমিক গবেষণা চলছে এখনো এবং সেসব গবেষণার মানও দুর্দান্ত। যতটুকু পড়েছি, প্রতিমুহূর্তে মনে হতো কত কম জানতাম ওনার সম্পর্কে।
একই কথা বলা যায়, এম কে গান্ধীর বেলায়। প্রতিবছর তাঁকে নিয়ে নতুন নতুন গবেষণাকাজ হচ্ছে। কেউ তথ্য-উপাত্ত হাজির করে দেখাচ্ছেন গান্ধী বর্ণবাদী ছিলেন, আবার অন্য কেউ দেখাচ্ছেন কীভাবে বিশ্বজুড়ে তাঁর আদর্শ ও রাজনৈতিক পদ্ধতি এখনো বিপুলভাবে প্রাসঙ্গিক। ভারতবর্ষের গান্ধীকে নিয়ে আফ্রিকাজুড়ে কী পরিমাণ যে লেখালেখি ও গবেষণা হচ্ছে, সেটা দক্ষিণ এশিয়ায় বসে আমরা অনুমানও করতে পারব না। এভাবে প্রতিদিন দুনিয়াজুড়ে ইতিহাসের গঠন ও পুনর্গঠন হয়। কোথাও কেউ সাইবার অ্যাক্ট করে সেই সব আটকানোর চেষ্টা করে না।
বাংলাদেশের পাকস্থলী এতটা শক্তিশালী নয়। এখানে বিতর্ক ও মতভেদকে নেতিবাচকভাবে দেখার রেওয়াজ। ইতিহাস নিয়ে, একাত্তর নিয়ে, মুজিবকে নিয়ে যেকোনো নতুন অনুসন্ধানের আগে ভাবতে হয় সমাজ কীভাবে নেবে সেটা, আওয়ামী লীগ কীভাবে নেবে, সাইবার অ্যাক্ট ঝামেলা করবে কি না, ডিজিটাল আইনে মামলা হবে কি না, মার খেতে হবে কি না।
অথচ বিশ্বের অন্যত্র রেওয়াজটা পুরোপুরি ভিন্ন। যে পাবলিক ফিগার বিশ্বের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতে যত প্রাসঙ্গিক, তাঁকে নিয়ে তত বিতর্ক চলছে। আবার যাঁদের নিয়ে যত আলোচনা হচ্ছে, তাঁরা তত নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন।
বিশ্বজুড়ে প্রায় সব ‘বড় নেতা’কে নিয়ে হামেশা নতুন নতুন গবেষণা হচ্ছে। সেসব গবেষণায় ওই মানুষদের নিয়ে নতুন নতুন সত্য পাওয়া যাচ্ছে। সেসব ‘সত্য’ নিয়ে আবার পুনরায় ময়নাতদন্ত হচ্ছে। কেউ তাতে বাধা দেওয়ার নেই। তাতে ওই সব পাবলিক ফিগারকে নিয়ে পাঠ-পুনঃপাঠ ক্রমে বাড়ছেই। গান্ধী থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা পর্যন্ত বহুজনের বেলাতে এ রকমই ঘটছে। ঐতিহাসিক ঘটনাবলির বেলায়ও নিত্যনতুন সত্য খুঁজে আনছেন গবেষকেরা। প্রকাশ্যে সাবলীলভাবে সেসব প্রকাশিত হচ্ছে। তাতে সেই সব ঘটনাবলি নিয়ে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ বাড়ছে।