শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় গ্রহণের পর তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বক্তব্য রাখেন। এতে স্বভাবতই প্রাধান্য পায় ‘কাঁচা আবেগ’। পরবর্তীকালে তার বক্তব্য অবশ্য বদলেছে। শেখ হাসিনা ও তার বোন গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগ করলেও বড় একটি দল তো রেখে গেছেন। তার সরকারের সদস্যদেরও অনেকে রয়ে গেছেন দেশে। বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী তো রয়েছেনই। তাদের একটা বড় অংশ রয়েছেন প্রতিশোধমূলক হামলাসহ কঠিন চাপের মুখে। শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের কঠিনতম সময়ে তাদের উদ্দেশে জনাব জয়ের ‘পাশে থাকার’ কথা বলাটা তাই স্বাভাবিক। যা হোক, পরবর্তীকালে সেটা তিনি বলেছেন।
এতে অবশ্য আছে কিছু অসংগতি; অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি এক ধরনের হুমকিও। হুমকি প্রদান না করলেই ভালো হতো। কেননা এরই মধ্যে কিছু ‘অস্বাভাবিক ঘটনা’ ঘটেছে-যেগুলোর সঙ্গে জনাব জয়ের বক্তব্যের যোগসূত্র আছে বলে মনে করা হচ্ছে। উচ্চ আদালতের ঘটনাবলি ও ‘হিন্দু কার্ড’ খেলার চেষ্টার কথা বলছেন অনেকে। একই দিন গোপালগঞ্জে একদল লোক নেমেছিল রীতিমতো ঢাল-সড়কি, রামদা নিয়ে। তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ‘দেশে ফিরিয়ে আনার’ দাবি জানাচ্ছিলেন। কিন্তু ঢাল-সড়কি নিয়ে নামার কারণ কী? তারা কি দেখেননি, শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ কীভাবে নেমেছিল অস্ত্রধারী গুন্ডা ও রণসাজে সজ্জিত পুলিশের সামনে? আত্মরক্ষায় তাদের হাতে বড়জোর ছিল লাঠি। শান্তিপূর্ণ এ বিক্ষোভ ক্রমে সহিংস হয়ে ওঠে বিগত সরকারের কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণে।
অপরদিকে আমরা দেখলাম, গোপালগঞ্জে সহিংস বিক্ষোভকারীরা সেখানে টহল দেওয়া সেনাসদস্যদের জখম করে, অস্ত্র ছিনিয়ে নেয় এবং পুড়িয়ে দেয় বাহন। এমন বিচারবুদ্ধিহীন হামলার মাশুল তাদের দিতে হবে। তবে আশা করব, মানবাধিকার সমুন্নত রেখেই এর প্রতিকার করা হবে। গোপালগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতারাও বুঝতে পেরেছেন, কাজটা ঠিক হয়নি। এমন দু-চার জায়গায় এসব করে পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে বিপরীতমুখী করা যাবে বলেও মনে হয় না। জনাব জয় কিংবা তার মা যদি কোনোভাবে এদের উসকিয়ে থাকেন, তবে বলব, ভুলের গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসার ইচ্ছা তাদের নেই।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি সরকার ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। এটি সেনাসমর্থিত শুধু নয়; গণঅভ্যুত্থান থেকে সৃষ্ট। নজিরবিহীন আত্মদানের পথ বেয়ে এসেছে। একে হালকা করে দেখা যাবে না। তবে জনাব জয়ের বক্তব্য পরে কিছুটা হলেও ‘রাজনৈতিক রূপ’ নিতে দেখা গেল। প্রভাবশালী বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি দ্রুত নির্বাচন দেওয়াটাই অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য ‘সবচেয়ে মঙ্গলজনক’ বলে বর্ণনা করলেন। নইলে নাকি ‘সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে’। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি কিন্তু সৃষ্টি হয়েছিল শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়ার পর। ১৭-১৮ কোটি মানুষের দেশ থেকে দুই লাখেরও বেশি পুলিশ সদস্য কার্যত গা-ঢাকা দিয়েছিলেন। তাদের কিছুসংখ্যক সদস্য নিহত হন উত্তেজিত জনতার হাতে।
এ পরিস্থতির আরও অবনতি ঘটলেও অবাক হওয়া যেত না। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে করে এমন একটা জায়গাতেই এনে দাঁড় করানো হয়েছে। রাজনৈতিক পক্ষগুলোর পালটাপালটি হানাহানির কথা এখানে না-ই বা তুললাম। জনাব জয় কি মনে করছেন, নিকট ভবিষ্যতে এর চেয়েও বেশি ‘বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে’? আর দ্রুত নির্বাচন দিয়ে ‘জনগণের কাছে বৈধতা’ আছে, এমন সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলেই সেটা ঘটবে? আর কাজটা সেরে ফেললেই দেশ হয়ে যাবে ‘সুশৃঙ্খল’? ব্যাপারটা কি এত সরল?
তিনি সম্ভবত এখনো বুঝে উঠতে পারছেন না, আওয়ামী লীগের কঠোর সমর্থক বাদে প্রায় সবার সমর্থন রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি। তারা এর সাফল্যও দেখতে চাইছেন। সাফল্য কীসে? দ্রুত একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরেই কি সেটা নিহিত? যাদের নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তাদের একাংশ কিন্তু বিগত সরকার দ্বারা বিভিন্নভাবে নির্যাতিত। ড. ইউনূসের প্রতি খোদ শেখ হাসিনার আচরণ তো সবার স্মৃতিতে তরতাজা। অন্য যারা উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছেন, তাদেরও প্রায় সবাই ‘সংস্কারবাদী’।
এর আগেও একটি সরকার এসেছিল, যেটি চেষ্টা করেছিল জরুরি কিছু সংস্কার আনতে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হন। এরপর তাদের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণকারী হাসিনা সরকার দেশকে নিয়ে যায় সংস্কারের যতটা সম্ভব বিপরীতে। নির্বাচন ব্যবস্থাও ধূলায় মিশিয়ে দেয়। এখন জয়ের দাবি অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজন করতে গেলেও তো এক্ষেত্রে ন্যূনতম কিছু সংস্কার আনতে হবে। সংস্কার-টংস্কার না করে ‘দ্রুত’ একটা নির্বাচন আয়োজন করে সরকার নিজের ‘মঙ্গল’ দেখলে বর্তমান পরিস্থিতিতে কারা আসবে বলে মনে করেন তিনি? জনাব জয়ের কঠোর সমর্থকরাও বলবেন-বিএনপি। তিনি কি তবে মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের চেয়ে বিএনপি নিরাপদ?
এএফপিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি কিন্তু বিএনপির সঙ্গে ‘একসঙ্গে কাজ করা’র বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছেন। এটা ‘কৌতূহলোদ্দীপক’ ঠেকতে পারে, কেননা আওয়ামী মহল থেকে বিএনপিকে ‘আগুনসন্ত্রাসী’ বলে বর্ণনা করে জামায়াতের সঙ্গে তাকেও নিষিদ্ধের দাবি উঠছিল। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। সেটা করে আন্দোলনকারীদের বিষয়ে বহির্বিশ্বে একটা সুবিধাজনক বার্তা দিতে চাইছিল বোধহয়। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আন্দোলন চলে গেছে সফলতার দিকে। আর এর পরিণতিতে আওয়ামী লীগই গেছে মাঠ থেকে হারিয়ে!