এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যে স্বাধীনতা পেয়েছিল, তা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বারবার ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। তবে গর্বের বিষয় হচ্ছে, সেই লুণ্ঠিত স্বাধীনতা এ দেশের ছাত্র-জনতা প্রতিবারই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা আরও একবার দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে আমাদের অপার সম্ভাবনার স্বর্ণদুয়ারে উপস্থাপন করেছে।
আমাদের সবার এখন এই স্বর্ণদ্বার উন্মুক্ত করে সম্মুখপানে এগিয়ে যেতে হবে। যেতে হবে এত দূরে, যেন আর কোনো শৃঙ্খল আমাদের সুউচ্চ গ্রীবায় চেপে বসতে না পারে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের কাছ থেকে দেশ স্বাধীনের পর আজ পর্যন্ত এই ৫৩ বছরে আমাদের একাধিকবার সংগ্রামের মাধ্যমে দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে হয়েছে। কিন্তু কেন বারবার আমরা নিজের দেশে নিজের মানুষের দ্বারা শৃঙ্খলিত হচ্ছি?
কেন আমরা বারবার একটি চক্রের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে দেশকে একটি নিশ্বাসহীন পরিবেশে নিক্ষিপ্ত করছি? এর উত্তর আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে, আর তা না হলে বারবার বয়ে যাওয়া প্রবল অনাকাঙ্ক্ষিত এই রক্তের স্রোত থামানো যাবে না।
জাতি হিসেবে আমরা অনন্য, স্বাধীনচেতা ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। যখনই স্বৈরশাসকেরা আমাদের টুঁটি চেপে ধরতে চেয়েছে, আমরা তাদের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছি। কিন্তু আমরা কি পেরেছি সেই আস্তাকুঁড়ের দরজায় ঘৃণার তালা দিতে? আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমাদের মাঝে সব সময় কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ ঘোরাফেরা করে।
এই মানুষগুলো তাদের নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য এক কল্পিত ঈশ্বরের অবতারণা করে আর সৃষ্টি করে ঈশ্বরের অমোঘ বাণী, যা কখনো আমাদের বাঙালি আর বাংলাদেশিতে বিভক্ত করে বা আমাদের হৃদয়কে মুক্তিযোদ্ধা বা রাজাকারের কল্পনাপ্রসূত চেতনায় উজ্জীবিত করে, যেন আমরা নিজেরাই নিজেদের শত্রুতে রূপান্তরিত হয়ে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে লিপ্ত হই আর এই সুযোগে কল্পিত ঈশ্বর তার ফেরেশতাদের নিয়ে তাদের আখের গোছাতে পারে।
এই সব ঈশ্বর এতটাই শক্তিশালী যে তারা তাদের মায়ার জাল দেশে থেকে বা বিদেশে বসেও বিস্তার করতে পারে আর তাদের ফেরেশতারাও অলৌকিক শক্তির বলে ক্ষণে ক্ষণে রং বদলাতে পারে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে ইহলৌকিক ঈশ্বর বলে কিছু নেই। আমরাই এদের সৃষ্টি করি।
এখন আমাদেরকেই অতি সাধারণ আর জনগণের প্রতি ভালোবাসাহীন মানুষগুলোকে ঈশ্বর বানানো থেকে বিরত থাকতে হবে। পারিবারিক পরিচয়ে অবিনশ্বর হয়ে ওঠার প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করতে হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার যে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যাদের আমরা মনোনীত করি, তারা আমাদের প্রতিনিধি এবং আমাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব।
আমাদের দ্বারা নির্বাচিত এই প্রতিনিধিরা কখনোই আমাদের প্রভু নয়, আর তাই প্রতিনিধি থেকে প্রভুত্ব অর্জনের ব্যক্তিগত বা সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে একটি কার্যকর ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেন রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়বদ্ধতার সৃষ্টি হয়।