দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি ঘটনা ঘটে গেল। গত ১ জুলাই শিক্ষার্থীরা যখন কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করে, তখন তা ছিল শান্তিপূর্ণ ও অহিংস। কিন্তু পরবর্তীকালে পরিস্থিতি অহিংস থাকেনি।
বিশেষ করে মধ্য জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি সহিংস রূপ ধারণ করে। একপর্যায়ে বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন, মেট্রোরেল, সড়ক ভবনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এটা স্পষ্ট, শিক্ষার্থীরা এসব হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল না।
তারা বলেছে, তারা কোনো রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলা চালায়নি। যা হোক, আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা তা কঠোর হাতে দমনের চেষ্টা করে। এতে অনেক তাজা প্রাণ অকালে ঝরে যায়। কারও কারও মতে, মৃতের সংখ্যা তিন শতাধিক। তাদের মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। বেশকিছু শিশু-কিশোর নিহত হয়েছে।
আন্দোলনকালে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা সত্যিই দুঃখজনক। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আর মৃতের কোনো আর্থিক মূল্যায়ন করা যায় না। যার সন্তান বা ভাই হারিয়েছে, একমাত্র তিনিই বোঝেন এ ক্ষতি কতটা ভয়াবহ ও অপূরণীয়। এদেশের ইতিহাসে আর কোনো আন্দোলনে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটেনি। সেনাপ্রধান জাতির উদ্দেশে দেওয়া তার ভাষণে বলেছেন, প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার করা হবে।
সবাই চায় আন্দোলনের সময় যেসব প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। কোন পরিস্থিতিতে কেন হত্যার মতো ঘটনাগুলো ঘটেছে, তা অনুসন্ধান করে বের করা প্রয়োজন। এবারের শিক্ষার্থী আন্দোলন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকেও ছিল ব্যতিক্রম। সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তা একদফা দাবিতে পরিণত হয়। সেই দাবি ছিল প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সব মন্ত্রীর পদত্যাগ। শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন।
সম্প্রতি আমরা যে শিক্ষার্থী আন্দোলন প্রত্যক্ষ করলাম, তা নানা কারণেই বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ আন্দোলন বেশ দীর্ঘস্থায়ী ছিল। ১ জুলাই আন্দোলন শুরু হয় এবং ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়। এরপর আন্দোলনকারীরা তাদের পছন্দমতো সরকার গঠনের জন্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে ব্যাপক প্রাণহানি ছাড়াও দেশের অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, তা কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যায় না। কারও কারও মতে, আন্দোলনের সময় দেশে উৎপাদন এবং অন্যান্য খাতে যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তার পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা থেকে ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এটা পূর্ণাঙ্গ হিসাব নয়।
সরকারিভাবে এখনো ক্ষয়ক্ষতির কোনো পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়নি। তবে ক্ষতির পরিমাণ যে ব্যাপক এতে কোনো সন্দেহ নেই। আন্দোলনের কারণে দেশের উৎপাদনব্যবস্থা বিপর্যস্ত হওয়া ছাড়াও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এগুলো মেরামত করে ব্যবহার উপযোগী করতে বেশ কিছুটা সময় ও অর্থের প্রয়োজন হবে।
আন্দোলন চলাকালে পরিবহণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকার কারণে পণ্য রপ্তানি কার্যক্রম বিঘ্নিত হয়েছে। রপ্তানিকারকরা বিদেশি বায়ারদের অর্ডার সঠিক সময়ে প্রেরণ করতে পারেননি। এ অবস্থায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্ডার বাতিল হয়ে যেতে পারে। আমদানি পণ্য খালাসকরণ এবং গন্তব্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। এতে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার কারণে স্থানীয় বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি একটি জটিল সমস্যায় পরিণত হয়েছে। গত প্রায় দুই বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রবণতা মোকাবিলা করে চলেছে দেশ। বিদ্যমান মূল্যস্ফীতির গড় হার সাড়ে ৯ শতাংশ। কোনোভাবেই মূল্যস্ফীতিকে কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা যায়নি। চলতি অর্থবছরের জন্য বাস্তবায়নাধীন বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।