আজ বিশ্ব শরণার্থী দিবস। বিশ্বের দেশে দেশে যুদ্ধ-দ্বন্দ্ব অথবা সহিংসতার শিকার শরণার্থীদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে ২০০১ সাল থেকে প্রতিবছর ২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস পালিত হয়। যদি কোনো ব্যক্তি তার বর্ণ, ধর্ম, জাতীয়তা, বিশেষ গোত্রের সদস্য অথবা রাজনৈতিক কারণে নিপীড়নের শিকার হওয়ার আশঙ্কায় নিজ বাড়ি ও দেশত্যাগ করে-আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুয়ায়ী তাকে শরণার্থী বলা হয়ে থাকে। ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) আন্তর্জাতিকভাবে শরণার্থীদের দেখভাল করে থাকে। ইউএনএইচসিআর এক বিবৃতিতে জানায়, ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বব্যাপী শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৬ কোটি ৩০ লাখ। দীর্ঘদিন ধরে চলা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সংঘাত, বিশেষত সুদানের গৃহযুদ্ধ, আফগানিস্তানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সব শেষ ইসরাইল-হামাস যুদ্ধই মূলত শরণার্থী সংকটকে বৃদ্ধি ও প্রলম্বিত করেছে। ইউএনএইচসিআর বলছে, শরণার্থী ছাড়াও এপ্রিল ২০২৪ পর্যন্ত জোরপূর্বক অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত (আইডিপি) মানুষের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। তবে যুদ্ধ, সহিংসতা ও গৃহযুদ্ধ ছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ অথবা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-হানাহানি অথবা রাজনৈতিক কারণেও আইডিপি হতে পারে। আবার বাধ্যতামূলক সব দেশ ত্যাগকারী শরণার্থীদের মর্যাদা না-ও পেতে পারে, যেমনটা প্রযোজ্য বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের বেলায়। কারণ বাংলাদেশ ২০১৬-১৭ সময়ে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসাবে স্বীকৃতি না দিয়ে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক বা এফডিএমএন হিসাবে অভিহিত করে।
বিশ্ব শরণার্থী দিবস শরণার্থীদের অধিকার, মর্যাদা, জীবিকায়নের চাহিদা এবং প্রত্যাবাসনের স্বপ্নকে গুরুত্ব দেয়। এছাড়া, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচারণা ও অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে শরণার্থীদের সম্মানজনকভাবে নিজ দেশে প্রত্যাবাসনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা উদ্বুদ্ধ করাও এ দিনটির প্রেরণা। উল্লেখ্য, শরণার্থীদের অধিকার ও স্বার্থ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৯৫১ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে রিফিউজি কনভেনশন স্বাক্ষরিত হয়, যদিও তখনকার উদ্যোগ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেওয়া ইউরোপীয় শরণার্থীদের স্বার্থকেন্দ্রিক। পরবর্তীকালে ১৯৬৭ সালে একটি প্রটোকল স্বাক্ষরের মাধ্যমে এ কনভেনশন বিশ্বব্যাপী প্রযোজ্য হয়। কনভেনশন অনুসারে শরণার্থীরা ১০ ধরনের অধিকার রাখে; যেমন-তাদের বহিষ্কার না করা, অনুপ্রবেশের জন্য শাস্তি প্রদান না করা, কাজের সুযোগ প্রদান, আশ্রয়, শিক্ষা, ত্রাণ পাওয়া, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা, আইনগত সুবিধা পাওয়ার সুযোগ, দেশের মধ্যে অবাধ চলাচলের সুবিধা এবং পরিচিতি ও ভ্রমণ দলিল পাওয়া। এর মধ্যে কিছু অধিকার অনেক দেশের জন্যই সংবেদনশীল; যেমন-শরণার্থীদের অবাধ চলাচল ও কাজ করার সুযোগ প্রদান। সম্ভবত বাংলাদেশ এসব কারণে রিফিউজি কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি, কারণ বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশের পক্ষে এ ধরনের শর্ত বা সুবিধা প্রদান আত্মঘাতী।
এ বছর বিশ্ব শরণার্থী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে-‘শরণার্থীদের সঙ্গে সংহতি’ (Solidarity with refugees), যার বার্তাটি হলো, সংহতি প্রকাশ শুধুই নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত অথবা দেশ ত্যাগকারী মানুষকে আশ্রয় দেওয়া নয়, বরং তাদের সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে নিরাপদ প্রত্যাবাসনে উদ্যোগী হওয়া। রিফিউজি কনভেনশন অনুসারে শরণার্থীকে নিজ দেশে প্রত্যাবাসনে বাধ্য করা যাবে না, যেখানে তাদের আবারও নিপীড়িত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শরণার্থীদের মর্যাদা ও অধিকার সম্পর্কে ইউএনএইচসিআর প্রধান (হাইকমিশনার) ফিলিপ্পো গ্রান্ডি এক বার্তায় বলেছেন, ‘শরণার্থীরা মানব কর্মশক্তিকে প্রতিনিধিত্ব করে। তারা সহযোগিতা ও সংহতি পাওয়ার অধিকার রাখে।’ তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে শরণার্থী সংখ্যা উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে। মানুষের মধ্যে সহিংসতা বাড়ছে। তিনি আক্ষেপ করেন-বৈশ্বিক মেরুকরণের কারণে সৃষ্ট আন্তর্জাতিক উত্তেজনা যাবতীয় মানবিক ইস্যুকে খারিজ করে দিচ্ছে। রিফিউজি কনভেনশনের মূলনীতি অনুসরণে দেশগুলোর মধ্যে শিথিলতার মাত্রা বাড়ছে, এমনকি কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী অনেক দেশের মধ্যেও এমনটা দেখা যাচ্ছে।
ফিলিপ্পো গ্রান্ডির বার্তা ও আক্ষেপ যেন সেই পুরোনো প্রবাদ ‘অরণ্যে রোদন’কেই মনে করিয়ে দেয়। কারণ শরণার্থীদের অধিকার প্রাপ্তিও স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ভিন্ন ও পক্ষপাতদুষ্ট হয়। বিশেষত, গাজার ১৭ লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী শুধুই ঘরছাড়া হয়নি, তারা শরণার্থী শিবিরেও নিরাপদ থাকছে না। ইসরাইলি হামলার আশঙ্কায় ইতোমধ্যে গাজার রাফা শরণার্থী শিবির ছাড়তে বাধ্য হয়েছে ১০ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি। কারণ, ইসরাইল সব আন্তর্জাতিক আইনকে উপেক্ষা করে শরণার্থী শিবিরেও হামলা করছে, যা জেনেভা কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন; কেননা, এ কনভেনশন অনুসারে কোনো পক্ষই বেসামরিক মানুষের ওপর হামলা করতে পারে না বরং বিবদমান পক্ষ তাদের সুরক্ষা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। উল্লেখ্য, ইসরাইল ১৯৫১ সালে জেনেভা কনভেনশন এবং ২০০৭ সালে এ প্রটোকল ৩ স্বাক্ষর করে। এদিকে, গাজার উদ্বাস্তুরা সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জাতিসংঘ ত্রাণ ও মানব উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউ) জানিয়েছে, গাজা উপত্যকার মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও বিশুদ্ধ পানি সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। শরণার্থীদের এমন দুর্ভোগ শুধুই গাজাতেই নয়, ছড়িয়ে আছে বিশ্বের দেশে দেশে, যেখানেই শরণার্থী আছে। অবশ্য, ইউক্রেনীয় শরণার্থীদের কথা আলাদা, কারণ তারা রিফিউজি কনভেনশন অনুসারে সব অধিকারই পাচ্ছে। তারা প্রচলিত অর্থে কোনো শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছে না, বরং প্রতিবেশী দেশগুলোতে একজন নাগরিকের মতোই সব সুবিধা ভোগ করছে।