সেনা শাসক জিয়াউর রহমানের হাত ধরে ক্যান্টনমেন্টের জন্ম হলেও পরবর্তীতে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে থেকে গণতান্ত্রিক চরিত্র অর্জন করে বিএনপি। বাংলাদেশের রাজনীতির মূলত দুটি ধারা— আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ বিরোধী। স্বাধীনতার আগে আওয়ামী লীগ বিরোধী ধারার নেতৃত্ব ছিল মুসলিম লীগের হাতে। স্বাধীনতার এক বছরের মাথায় আওয়ামী লীগের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাঠে নামে জাসদ। ৭৫এর ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। আওয়ামী লীগ বিরোধী ধারার নেতৃত্ব চলে আসে বিএনপির হাতে। স্বাধীনতাবিরোধী, ডান-বামের অদ্ভুত এক মিশেলে বিএনপি এক রাজনৈতিক প্লাটফর্মে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগ বিরোধী সব ভোট একত্রিত হলে বিএনপি দারুণ জনপ্রিয়তাও পায়। এরশাদ পতনের পর ৯১ সালের নির্বাচনে সবাইকে অবাক করে দিয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। এরপর ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির স্বল্প মেয়াদসহ চার মেয়াদে ক্ষমতায় আসে দলটি, বেগম খালেদা চার সরকারেরই নেতৃত্ব দেন। কিন্তু দলটি এখন চরম সংকটের সময় পার করছে। ২০০৬ সালের পর থেকে টানা ১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে দলটি। কার্যত নির্বাচনী প্রক্রিয়ারও বাইরে দলটি।
২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে দলটি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দারুণ জয় পেলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জাতীয় নির্বাচন বর্জন করে তারা। শুধু বর্জন নয়, নির্বাচন ঠেকাতে দেশজুড়ে ব্যাপক অগ্নিসন্ত্রাস চালায় দলটি। বর্জন করলেও নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি বিএনপি। তাতে দুটি ক্ষতি হয়। ফাঁকা মাঠে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তাতে বিএনপির দুটি ক্ষতি হয়। প্রথমত, তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়া, ক্ষমতা ও সংসদীয় কার্যক্রমের বাইরে ছিটকে যায় দলটি। দ্বিতীয়ত অগ্নিসন্ত্রাসী দলের তকমা লেগে যায় বিএনপির নামের সাথে। বিএনপি ভেবেছিল, ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর তারা যেমন ক্ষমতায় টিকতে পারেনি, আওয়ামী লীগও পারবে না। কিন্তু বিএনপি জ্বালাও-পোড়াও করলেও সরকার পতনের মতো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। ২০১৪ সালের নির্বাচন নৈতিকভাবে উচ্চমানের না হলেও তা অবৈধ ছিল না এবং আওয়ামী লীগের টানা পাঁচ বছর দেশ পরিচালনায় কোনো সমস্যা হয়নি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়— এই দাবি থেকে সরে এসে বিএনপি ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়। তবে সেটি ছিল নিজেদের নিবন্ধন টিকিয়ে রাখতে নামকাওয়াস্তে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে না গিয়ে বিএনপির যতটা ক্ষতি হয়েছে, ২০১৮ সালে গিয়ে তারচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। মাত্র ছয়টি আসন বিএনপির ভাবমূর্তিতে বড় ধাক্কা দেয়। ২০১৮ সালে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে গেলেও ২০২৪ সালে এসে আবার তারা আগের অবস্থানে ফিরে যায়— বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। এবার অবস্থান আরও কড়া— তত্ত্বাবধায়ক সরকার শুধু নয়, সরকার পতনের একদফা দাবিতে অনড় থাকে বিএনপি। এমনকি সরকারের পদত্যাগ ছাড়া কোনো আলোচনায় বসতেও রাজি ছিল না বিএনপি। ফলে আওয়ামী লীগ আবারও ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার সুযোগ পায়। গত দুই বছরে দেশজুড়ে সভা-সমাবেশে বিপুল জনসমাগম এবং নির্বাচনের ব্যাপারে বিদেশিদের বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অবস্থান বিএনপিকে আশাবাদী করেছিল। কিন্তু গত বছরের ২৮ অক্টোবর উত্তেজিত কর্মীদের অবিমৃশ্যকারিতায় সরকারের কৌশলের কাছে হেরে যায় বিএনপি। নামকাওয়াস্তে সরকার পতনের একদফা এবং পরে সর্বাত্মক অসহযোগের ডাক দিয়েও নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি বিএনপি। বরং আন্দোলনের চূড়ান্ত সময়ে তাদের মাঠে খুঁজেই পাওয়া যায়নি। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা থাকলেও বিদেশি শক্তিগুলো, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রও সরকারের সাথে কাজ করার অঙ্গীকার করেছে। বিএনপি এখন বলছে, আন্দোলনে তাদের নৈতিক জয় হয়েছে। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে ভোটাররা কেন্দ্রে যায়নি। এই নৈতিক জয় ধুয়ে বিএনপি পানি খেতে পারে। কিন্তু আওয়ামী লীগের টানা চতুর্থ মেয়াদের ক্ষমতায় কোনো আচড় বসাতে পারেনি।