নতুন বছরের অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি কোন দিকে যাচ্ছে তা নির্ভর করছে আগের বছর অর্থনীতি কেমন ছিল তার ওপর। ফেলে আসা ২০২৩ সালটি কেমন ছিল তা যদি দেখি তাহলে খুব ভালো কিছু আমরা দেখতে পাইনি। ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে যে সংকটগুলো শুরু হয়েছিল তা ২০২৩ জুড়েই আমাদের ভুগিয়েছে। কোনো কোনো সমস্যা আরো ঘনীভূত হয়েছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে সমস্যা সমাধানের প্রয়াস দেখা গেছে। ২০২৪ সালে আমরা পা দিয়েছি ২০২৩ সালের সমস্যা নিয়েই। এখন যদি বলেন কোন কোন সমস্যা। তাহলে প্রথমেই বলতে হয়, আমাদের মূল্যস্ফীতি সমস্যার কথা। আমাদের ২০২৩ সালজুড়েই কিন্তু মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। সেটা ২০২৪ সালেও কিছুদিন পর্যন্ত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমানোর প্রচেষ্টাটা আমাদের আগেই করা উচিত ছিল; তাতে দেরি করেছি। সুদের হার বাড়িয়ে অন্যান্য দেশ মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করেছে। আমাদের এখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার পর সুদহার বাড়ানো হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য যে মুদ্রানীতি দরকার ছিল তার প্রয়োগ আমরা দেখিনি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে এসে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করেছে। সেটাও আবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পালনের অংশ হিসেবে নেয়া হয়েছে। আইএমএফ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্তের মধ্যে ছিল সুদহার, টাকা-ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে, বৈদেশিক মুদ্রায় রিজার্ভ বাড়াতে হবে। আইএমএফের পরামর্শে সুদহার বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হলো কিন্তু একটা পলিসি কার্যকর হতে তো কিছুটা সময় লাগে। আবার এটাও মনে রাখতে হবে যে কোনো পলিসি এককভাবে সব পরিবর্তন আনতে পারবে না, সঙ্গে প্রয়োজনীয় অন্যান্য পদক্ষেপ গ্রহণও জরুরি। যেমন মূল্যস্ফীতির কথাই ধরা যাক, যদি রাজস্ব নীতি সংকোচনমূলক না হয় তাহলে স্রেফ সুদহার বাড়িয়ে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সরকার যদি দেদার খরচ করে যায় তাহলে তো মুদ্রানীতিটা ঠিকভাবে কাজ করবে না। বাজারে অর্থের সরবরাহ কমাতে চাইলে কিন্তু সরকারের পরিচালন ব্যয়, প্রশাসনিক ব্যয় এগুলো কমানো দরকার। অগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে ব্যয় কমিয়ে প্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রকল্প নির্বাচন করতে হবে। প্রয়োজনে কিছু প্রকল্প স্থগিত বা বাতিল করতে হতে পারে। মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতির মধ্যে একটা সমন্বয় সাধন করতে হবে।
আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতির পেছনে প্রাতিষ্ঠানিক ও রেগুলেটরি ব্যর্থতা রয়েছে। অর্থাৎ বাজার ব্যবস্থাপনায় একটা ত্রুটি দেখা যায়। বাজারে অনেক ধরনের খেলোয়াড় থাকে যারা মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। পণ্য আমদানিতে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মনোপলি দেখা যায়। এতে বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে তাদের ক্ষমতা থাকে। হয়তো কখনো তারা অজুহাত দেয়, আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি দাম থাকায় তাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এ কারণে তাদের বেশি দামে বাজারে ছাড়তে হচ্ছে। কিন্তু এখন তো আর সেই অজুহাতটা দেয়া সম্ভব না। দেখা গেছে, কম দামে আমদানি করলেও আগের বর্ধিত দাম রেখে দিচ্ছে। এতে দ্রব্যমূল্য কমছে না। আরেকটা জিনিস হচ্ছে আমদানি পণ্যের দামের সঙ্গে সঙ্গে দেশে উৎপাদিত পণ্যের দামও বেড়ে যায়। এটা ব্যবসায়ীদের একটা কারসাজি। আমাদের দেশে এত শাকসবজি বা কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন হচ্ছে তাতে তো সংকট হওয়ার কথা নয়। সাধারণত, বাজারে দাম নির্ধারিত হয় সরবরাহ ও চাহিদার ভিত্তিতে। বাজারে সরবরাহের ঘাটতি নেই, তাহলে হঠাৎ করে দাম উল্লম্ফন করার কথা ছিল না। অথচ কয়েকদিন পরপর আমরা এমন দৃশ্যই দেখছি। কখনো কাঁচামরিচ, কখনো-বা আলু, ডিম, পেঁয়াজ ইত্যাদির দাম হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। বাজারে যে কারসাজি হচ্ছে তা এ বাজার ব্যবস্থাপনারই দুর্বলতা।