যুগান্তরের উপসম্পাদকীয় কলামে (৩১.১২.২৩) ‘বাজেট সংকোচনের সময়ে ব্যয়বহুল নির্বাচন’ শিরোনামে নিবন্ধটি পড়লাম। দেখলাম, এবারের নির্বাচনে খরচের জন্য ২ হাজার ২০০ কোটি টাকার বেশি চাইছে নির্বাচন কমিশন। নাচতে গিয়ে তো আর ঘোমটা দেওয়া চলে না, নাচার মতোই নাচতে হয়। কথায় আছে, ‘শয়তানকেও তার পাওনাটা দাও’। খরচের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনেরই-বা কী করার আছে! খরচ করে বিভিন্ন ধরনের কাজের ব্যয় তো নির্বাহ করতেই হবে। এ খরচকে তো আমি টাকার ‘অপচয়’ বলতে পারি না। তবে একই খরচ বারবার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই করতে হলে তাকে ‘অপচয়’ তো বলতেই হবে। দেশের ‘গণতন্ত্র’ রক্ষায় অন্তত এ খরচটুকু তো করতেই হবে। দেশের ‘গণতন্ত্রের (?) লাইসেন্স নবায়নে’ এটা তেমন বেশি কিছু নয়। তার চেয়ে শতগুণ বেশি অবৈধ টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, ব্যাংক লুট হচ্ছে, কিংবা ‘রাজনৈতিক ব্যবসায়ীরা’ দেশীয় অর্থ বিনা-আয়করে আত্মসাৎ করছে। জনসাধারণ নিয়ে ভাবনার তেমন কিছু নেই। এদের সহ্যসীমা অনেক বেশি। ডলারের দাম বেড়েছে, দ্রব্যমূল্য ব্যাপকভাবে বেড়েছে-এতে আমি যতটা না উদ্বিগ্ন, তার চেয়ে পুলকিত যে, বর্ধিত অসংখ্য পণ্যমূল্যের ওপর অব্যাহত নির্দিষ্ট হারে ভ্যাট কর্তনের ফলে সরকারের আয়ও বেড়েছে। সে অর্থে কিংবা অধিক হারে সুদে টাকা ধারদেনা করে আনা অর্থে নির্বাচনব্যয় মেটানো যাবে। খরচে স্বাচ্ছন্দ্য আসবে।
‘অবচয়’ ও ‘অপচয়’ শব্দযুগল নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লিখিত বিষয়টি চলে এসেছে। এগুলো সম্পর্কযুক্তও বটে। শব্দযুগলকে আমি ছাত্রজীবনে প্রায়ই গুলিয়ে ফেলতাম। এখন মোটামুটি বশে এসেছে। এখানে আমি একাউন্টিংয়ের ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছি না। পাঠকমহলকে এদেশের বাস্তবতার আলোকে বিষয় দুটোকে তুলে ধরছি। অবচয় (Depreciation) কোনো স্থায়ী সম্পদের মোট আয়ুষ্কালের খরচকে প্রতি ছোট ছোট সময়ের মধ্যে (যেমন প্রতি বছর) ব্যবহারজনিত ক্ষয়ের ফলে একটা নির্দিষ্ট ভিত্তিতে ভাগ করে দেওয়া। অসুবিধা অন্য কোথাও। এ অপবাদ (নাকি মতবাদ?) আমাদের চিরন্তন যে, ‘সরকারকা মাল, দরিয়ামে ঢাল’। আমিও একমত পোষণ করি। সরকারি মাল দরিয়ায় ঢালব না তো নিজের মাল দরিয়ায় ঢালব নাকি! বাঙালিদের মধ্যে এত পাগল কেউ আর আছে বলে মনে হয় না। ধরুন সরকারি বাস কোম্পানির কথা। অনেক কোটি টাকা ব্যয় করে বিদেশ থেকে ‘ভলভো’ নামের দোতলা দামি বাস অনেকগুলো কিনে আনা হলো। কার্যকর আয়ুষ্কাল ধরা হলো প্রতিটির ১২ বছর করে। কোম্পানির কর্মচারীরা বাসের সামনের গ্লাস ছাড়া পাশের বা পেছনের গ্লাসগুলো তেমন একটা মোছে না। সরকারি হাতের স্নেহ-মমতা সরকারি সম্পদকে স্পর্শ করে না। অযত্নে-অবহেলায় এমনই অবস্থা হয় যে, এক বছর যেতে-না-যেতেই গ্লাসগুলো স্পটেড হয়ে যৌবন হারিয়ে বুড়ো হয়ে যায়। অতি তাড়াতাড়ি লক্কড়মার্কা হয়ে যায়। গাড়ির ভেতরের অবস্থাটাও এ অবহেলা থেকে রক্ষা পায় না। কখনো যন্ত্রাংশ হারাতে থাকে।
১২ বছরের আয়ুষ্কাল যদি পাঁচ বছরে নেমে আসে, প্রতি বছরের অবচয় বাবদ খরচ কত বাড়বে? আবার এক টাকার জিনিস যদি তিন টাকায় কিনি; অবচয় বাড়বে, না কমবে? দু-জায়গায় ফাঁকি। সুবিধা হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি কিনতে পারি ততই অতিরিক্ত মূল্যের লাভটা পকেটে আসে। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালের কোটি কোটি টাকা দামের যন্ত্রপাতি কতগুণ বেশি দামে কেনা হয়? যন্ত্রপাতির ভেতরের পার্টস (যন্ত্রাংশ) কেমন মানের দেওয়া হয়? প্রতিনিয়ত পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে, জেনে নিন। ছয় মাস না যেতেই নষ্ট ও বিকল হয়ে পড়ে থাকে। হাসপাতালে যন্ত্রপাতি ঠিকই থাকে, কিন্তু অব্যবহার্য (রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটা বালিশ নিচ থেকে ওপরতলায় উঠাতে কত টাকা ব্যয় হয়েছিল?)। কারণ ও অবচয়ের পরিমাণ জানার জন্য চোখ-কান খোলা একজন বাঙালিই যথেষ্ট, বিদেশ থেকে গবেষক ভাড়া করে আনার দরকার আছে কি? সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বিষয়গুলো আমলে নেয় কিনা? হ্যাঁ, নেয়। মুখরক্ষার জন্য সাময়িকভাবে নেয়। বিষয়গুলোর ‘লোম বাছতে গেলে কম্বল উজাড় হবে’ সে-ভয়ে চুপ করে যায়। সরকারি প্রতিটি দপ্তরে, প্রতিটি সেক্টরের একই দশা, কিছু কম-বেশি। ‘খেলা চলছে হরদম! হরদম! হরদম! এ কী খেলা চলছে হরদম? একদিকে নিরন্ন মানুষ, আরেক দিকে (দুর্নীতি নামের) এটম’। যে দেশের মানুষের সব কিছু সয়, নির্বাচনব্যয়ই-বা সইবে না কেন? গণতন্ত্র আসুক বা না আসুক, নির্বাচনের নামে টাকার অবস্থানের পরিবর্তনের হার (বেগ) (Velocity of money) তো অন্তত বাড়ছে। অনেককেই নির্বাচন নিয়ে ভাবতে দেখি। আমি কিন্তু একটুও ভাবি না। আমার ভাবনা দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে। এদেশ কীভাবে চলছে ও চলবে-তা নিয়ে। আমি ভাবি, আমার তো বিদায় নেওয়ার পালা চলে এসেছে, আমার স্নেহধন্য ছেলেমেয়ে ও ছাত্রছাত্রীদের জন্য ভবিষ্যৎ কী দশা অপেক্ষা করছে, তা নিয়ে।