যে কোনো রাজনৈতিক দলই গঠিত হয় সুনির্দিষ্ট মতাদর্শের ভিত্তিতে। আদর্শের ভিত্তিতে। নিজেদের মত তুলে ধরে জনগণের ম্যান্ডেট প্রত্যাশা করে। একটি রাজনৈতিক দল দেশের নাগরিকদের একটি দল, যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা এবং সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে একত্র হয়। দলটি সামষ্টিক কল্যাণ কিংবা তাদের সমর্থকদের চাহিদা অনুসারে কিছু প্রস্তাবিত নীতি ও কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐকমত্য পোষণ করে। বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। তাদের কারও মতে, ‘রাজনৈতিক দল হলো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের মাধ্যম, ক্ষমতা লাভে সফল হলে তারা ওই ক্ষমতা প্রয়োগ করে।’ কারও মতে, রাজনৈতিক দল হলো একটি সুসংগঠিত জনসমষ্টি, যারা কোনো নির্দিষ্ট নীতির দ্বারা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং যৌথ প্রচেষ্টার দ্বারা জাতীয় স্বার্থরক্ষার চেষ্টা করে।’
বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের ইতিহাস বেশ ঐতিহ্যম-িত। তবে ভিন্নতা রয়েছে স্বাধীনতার পূর্ব ও পর রাজনীতিতে। স্বাধীনতার আগে দেশের বেশির ভাগ মানুষের মত ছিল একটি। স্বাধীনতার পর ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে মতের ভিন্নতা তৈরি হয়। ফলে বাড়তে থাকে রাজনৈতিক মতের বিভাজন। এই বিভাজনের কারণে দল ভেঙেছে, গড়েছে। এ সুযোগে অরাজনৈতিক গোষ্ঠী রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে। রাষ্ট্র শাসন করেছে। শুধু শাসনই করেনি পরবর্তী সময় অরাজনৈতিক গোষ্ঠী দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও আসন গেড়ে বসেছে। সামরিক শাসকরা যে কাজটি সূক্ষ্মভাবে করেছে তাহলো বড় দলগুলোর মধ্যে সুকৌশলে বিভাজনের বীজ বপন করেছে। যে কারণে আমরা আশির দশক থেকে অনেক রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব দেখেছি। যেহেতু এই দলগুলো বিভাজনে সৃষ্টি, তাই তারা রাষ্ট্র পরিচালনায় সরাসরি ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। রাজনীতিতে তারা যুগের পর যুগ ধরে ছোট দল হিসেবেই টিকে আছে, বড় দলের ছায়াশক্তি হিসেবে। সেখানে মত-আদর্শের বালাই নেই।
স্বাধীনতার পর আমরা মূলত দুই ধরনের বড় শক্তির দল পেয়েছি। একটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অন্যটি স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদের আদিষ্ট। এর বাইরে বাম ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রচলন আমাদের সব সময়ই ছিল। সেটা এখনো আছে। কিন্তু এসব দলের মত-বিভাজন বড় দুই পন্থি দলের চেয়েও বেশি। যে কারণে বাম রাজনীতিকরা বা ধর্মীয় রাজনীতির দলগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহায়ক শক্তির বাইরে কিছু করতে পারেনি। তবে তাদের কিছুটা স্বকীয়তা ছিল। যেমন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, সাম্যবাদী দল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টির মতো দলগুলোর নিজস্ব কিছু আদর্শ-মত ছিল। কিন্তু জনসাধারণের মধ্যে সে আদর্শ বা মত প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। টিকে আছে তাদের নেতৃত্বের গুণে। এই দলগুলো অনেক ভাগে বিভক্ত। কিন্তু তাদের মতের আদর্শে দেশের জনসাধারণকে উদ্বেলিত করার সক্ষমতা কখনো দেখা যায়নি। অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক দলগুলো নিজের মত নিয়ে অনেক শাখা-উপশাখায় ছড়িয়ে টিকে আছে কেবল। তারাও টিকে আছে মত বা আদর্শের মাধ্যমে নয়, বড় দলের ছায়াশক্তি হিসেবে।