আমার কৈশোর কেটেছে গ্রামে। তখন শীতের মৌসুমে যাত্রাগানের ধুম পড়ত। অধিকাংশ যাত্রাপালাতে রাজায় রাজায় যুদ্ধ হতো। রাজা বা সেনাপতি প্রতিপক্ষকে বুক ফুলিয়ে বলতেন, ছলে বলে কৌশলে তোমাকে পরাস্ত করবই। ছল, বল ও কৌশলই সামন্ত যুগের বিধান। তবে সত্যিকার বীরদের মধ্যে মূল্যবোধও ছিল। তখন যুদ্ধের ময়দানে নিরস্ত্র প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমণ করা হতো না, বন্দিদের যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদর্শন করা হতো।
১৫৯৭ সালে বিক্রমপুরের সন্নিকটে ঈশা খাঁর সঙ্গে মোগল বাহিনীর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে রাজা মানসিংহের পুত্র দুর্জনসিংহ নিহত হন। কথিত আছে, পুত্র হত্যার বদলা নিতে বিশাল বাহিনী নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন স্বয়ং মোগল সেনাপতি মানসিংহ। ঈশা খাঁ অহেতুক রক্তপাত না ঘটিয়ে মোগল সেনানায়ককে তাঁর সঙ্গে দ্বৈত যুদ্ধে আহ্বান জানান। এ প্রস্তাবে মানসিংহ সম্মত হন। শুরু হলো দুই বীরের যুদ্ধ। মোগল ও বঙ্গবাহিনীর সৈন্যরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ দেখছেন। চরম উত্তেজনা; কে হারেন, কে জেতেন? হঠাৎ মানসিংহের তরবারি হস্তচ্যুত হয়। ঈশা খাঁ মানসিংহকে আঘাত না করে তাঁকে নিজের তরবারি এগিয়ে দেন। মানসিংহ প্রশ্ন করলেন, সুযোগ পেয়েও আমাকে আক্রমণ করলেন না কেন? জবাবে ঈশা খাঁ বললেন, নিরস্ত্র ব্যক্তিকে আক্রমণ করা কাপুরুষের কাজ, তাতে কোনো বীরত্ব নেই। মুগ্ধ মানসিংহ ঈশা খাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। তাদের মধ্যে সন্ধি হলো। ঘটনাটির সত্যতা ইতিহাসবিদরা নিরূপণ করবেন। আমার কাছে শিক্ষাটা তাৎপর্যপূর্ণ। সামন্ত যুগেও নিরস্ত্র প্রতিপক্ষের ওপর হামলার মধ্যে বীরত্ব ছিল না, ছল ও কূট-কৌশল প্রয়োগও মর্যাদার বিষয় ছিল না।
দুর্ভাগ্যজনক যে, আমাদের রাজনীতিকরা সামন্ত যুগের ‘ছলে বলে কৌশলে’ প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার নীতি গ্রহণ করেছেন; নিরস্ত্র প্রতিপক্ষকে আক্রমণ না করার নীতি ধারণ করতে পারেননি। এর প্রমাণ গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশ কেন্দ্র করে সরকারের আচরণ। সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ে বিএনপির সভাকে কেবল পণ্ড করেই পুলিশ বাহিনী নিবৃত্ত হয়নি। তারা নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। এখনও নেতাকর্মীরা কার্যালয়ে যেতে পারছেন না। আর যাবেনই কী করে? এই ঘটনার পর ১০-১২ হাজার নেতাকর্মীকে জেলে পুরা হয়েছে। বিএনপি নেতাকে না পেয়ে ভাই বা বাবাকে তুলে এনেছে, এমনকি স্ত্রীকে ধরে এনে জেলে ঢুকিয়েছে। পাইকারি হারে মামলা দেওয়া হয়েছে। আসামির তালিকায় প্রবাসী ও মৃত ব্যক্তিরাও আছেন। ফরিদপুরের সালথা উপজেলায় মামলার তালিকায় একজন আওয়ামী লীগ নেতার নামও ছিল। তাড়াহুড়া করায় এমন ভুল হয়েছে। তাড়াহুড়ার কারণ বোধগম্য, নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগেই সব নেতাকর্মীকে জেলে পোরার ছক। যত দ্রুত গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তার চেয়ে দ্রুতগতিতে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। আরও ভয়াবহ ঘটনা, কিছু রহস্যজনক মৃত্যু ও অপহরণ। রাজশাহীতে প্লেটবিহীন সাদা মাইক্রোবাসে দুই জামায়াত সমর্থক চিকিৎসককে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সমকালের প্রতিবেদন, ‘জেলায় দুই চিকিৎসকের আলোচিত হত্যা, হরিয়ান বাজারে এক ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যাচেষ্টা, লালপুরে যুবদল নেতাকে মৃত ভেবে গর্তে ফেলে যাওয়ার সব ঘটনাতে পাওয়া গেছে সাদা মাইক্রোবাসটির সংশ্লিষ্টতা। … গত শুক্রবার একইভাবে লালপুরের বিলমাড়িয়া ইউনিয়ন যুবদল নেতা মাসুদ রানাকে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায় একটি দল। তারা নির্জন স্থানে মাসুদকে রড দিয়ে পিটিয়ে ডান হাত ও ডান পা ভেঙে দেয়। চাকু দিয়ে শরীরে ক্ষত-বিক্ষত করার পর মৃত ভেবে একটি গর্তে ফেলে চলে যায়।’
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মাসুদ জানান, রাত পৌনে ১০টার দিকে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফেরার পথে সাদা মাইক্রোবাস এসে তাঁকে তুলে নেয়। তারা নাম-ঠিকানা জিজ্ঞাসা করার পরে বলে, ‘শালা ঢাকা গেছিলি? বিএনপি করিস? থানায় চল, বিএনপি করাচ্ছি।’ (সমকাল ৬ নভেম্বর ২০২৩)। এমন ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী, রংপুর, নাটোরসহ দেশের নানা স্থানে।
বিরোধী দলের প্রতি দমন-পীড়ন নতুন নয়, তবে বর্তমানের দমন-পীড়নের বিষয়টি ব্যতিক্রম। অতীতে নির্বাচনের সময়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীকে মুক্তি দেওয়া হতো, এবার নির্বাচনকে সামনে রেখে পূর্ণোদ্যমে ধরপাকড়, হামলা-মামলা হচ্ছে।