বাংলাদেশের নির্বাচন সামনে রেখে ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) একটি জরিপ করে যেসব তথ্য জানিয়েছে, তার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। তবে ক্ষমতাসীন বা বিরোধী কোনো পক্ষকেই এ নিয়ে উচ্ছ্বসিত হতে দেখা যায়নি। জরিপে কিছু পরস্পরবিরোধী তথ্য উঠে আসাতেই সম্ভবত এমন প্রতিক্রিয়া তাদের। জরিপটি নিয়ে বেশি আলাপও বাজারে নেই। তবে তাদের পরিবেশিত কিছু তথ্য দৃষ্টি কেড়েছে। যেমন– জরিপে অংশগ্রহণকারী ৯২ শতাংশ মানুষ ভোট দিতে ইচ্ছুক। ভোট দিয়ে আশানুরূপ শাসন কম পেলেও এ দেশের মানুষ ভোট দিতে চায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় নির্বাচনে তারা বেশি হারে ভোট দিয়ে থাকে। কেননা, স্থানীয় সরকারকে তারা মনে করে ‘হাতের কাছের সরকার’। তাই হয়তো নির্বাচন ব্যবস্থা নজিরবিহীনভাবে ভেঙে পড়ার পরও অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য হারে ভোট পড়তে আমরা দেখেছি। আর জাতীয় নির্বাচন গ্রহণযোগ্যভাবে হলে তো লোকে উৎসব করে ভোট দিতে যায়। তখন হয়তো এটুকু ভেবেই আনন্দ বোধ করে, তাদের সম্মতিতেই সরকার গঠন হতে যাচ্ছে। সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০০৮ সালের নির্বাচনে রেকর্ড ৮৭ শতাংশ ভোট পড়েছিল। আলোচ্য জরিপ অনুযায়ী আগামী নির্বাচনে ৯৩ শতাংশ মানুষ ভোট দিতে চাইলে তাই অবাক হওয়া যাবে না। সত্যি বলতে, বিগত দুটি নির্বাচনে তারা তো স্বাভাবিক কোনো পরিবেশই পায়নি ভোট দেওয়ার। এর কোনটিতে কত শতাংশ ভোট পড়েছিল, সেটা নিয়ে কথা বলারও বোধ হয় কোনো মানে নেই।
দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনেই লোকে বেশি হারে ভোট দিতে গেছে। দেশের কোনো কোনো এলাকায় ভিন্ন চিত্র দেখা গেলেও যেতে পারে; সাধারণভাবে চিত্রটা এমনই। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তো শুধু অংশগ্রহণকারী দল নয়; তাদের সমর্থক, ‘সুইং ভোটার’– সবার জন্যই জরুরি। শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা এ জন্যই বলা হয়ে থাকে। নির্বাচনের সেই পরিবেশ কারা নিশ্চিত করতে পারে, তা নিয়ে বিতর্কও এ দেশে ঘুরেফিরে আসছে। আমরা তো ভেবেছিলাম, ১৯৯৬ সালে খোদ সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংযোজনের মাধ্যমে এর একটা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। তখন অনেকে উচ্ছ্বসিত হয়ে এমনটাও বলতাম, যেসব দেশে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক আছে– তারা এ বন্দোবস্ত অনুসরণ করতে পারে। পাকিস্তান অবশ্য আরও আগে এ ব্যবস্থায় গিয়েছিল এবং এখনও তা বহাল। সত্যি বলতে, পাকিস্তানে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক বাংলাদেশের তুলনায় কম। বিরোধী দলও সেখানে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের মতো করে অনাস্থা জানায় না। ইমরান খান সরকারের পতনের পর দেশটিতে যেসব উপনির্বাচন হয়েছে, তাতে কিন্তু তাঁর নেতৃত্বাধীন দলই জয়ী হয়েছে সিংহভাগ আসনে। আর এ দেশে মাঠের বিরোধী দলটি শুধু উপনির্বাচন নয়, স্থানীয় নির্বাচনও বর্জন করছে এগুলো গ্রহণযোগ্য হবে না বলে। দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ছাড়া তারা কোনোভাবেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে।
এ অবস্থায় আইআরআই-এর জরিপে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে অংশগ্রহণকারীদের যে তিন ভাগে বিভক্ত মতের খবর দেওয়া হয়েছে, সেটাও নজর কাড়ে। জরিপ অনুযায়ী, ৪৪ শতাংশ মানুষ এ ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার পক্ষে। ২৫ শতাংশ মনে করে, বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে। আরও ২৫ শতাংশ মনে করছে, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল মিলে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে নির্বাচনটি হতে পারে। আমরা অনেকে হয়তো মনে করি, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে দেশ শুধু দু’ভাগে বিভক্ত। তা নাও হতে পারে। দেশ হয়তো তিন-চার ভাগে বিভক্ত। চার ভাগের কথাটা তুললাম এ জন্য, দেশের একটা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ হয়তো মনে করে, নির্বাচনটা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে। সব মিলিয়ে এর সম্ভাবনা খুব কম হলেও তারা হয়তো নিজেদের মতো ব্যাখ্যা করে বলতে চাইবে, কেন অন্য কোনো উপায়ে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন এখন আর সম্ভব নয়।