কে লিখবে সেই ইতিহাস? বঙ্কিমচন্দ্র বেঁচে থাকলে হয়তো আক্ষেপ করতেন। কারণ আমাদের ইতিহাসের দৈন্য ও দুঃখ অনেক। বোধ হয় সবচেয়ে বড় দুঃখ এই যে, আমরা আমাদের কৃতী সন্তানদের যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পারি না। মানিক মিয়া ছিলেন এ দেশেরই কৃতী সন্তান। তার কৃতিত্ব কেবল সাংবাদিকতার একজন মহান দিকপাল হিসেবেই নয়, তিনি ছিলেন এ দেশে জাতিসত্তার সংগঠক, গণতন্ত্রের ও আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ। তার ‘রাজনৈতিক মঞ্চের’ তীব্র কশাঘাতে একসময় জেগে উঠেছিল বাঙালি জাতি। তার লেখনী গোটা জাতি, বিশেষত এ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলেছিল। আমাদের মুক্তিসংগ্রাম সেই চেতনারই অবশ্যম্ভাবী ফসল। আমাদের স্বাধীনতা তাই ‘ইত্তেফাক’ ও তার অকুতোভয় সম্পাদক মানিক মিয়ার কাছে ঋণী। ইতিহাসের প্রতি আনুগত্য রেখে এ দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রতিটি ঘটনাপরম্পরার পাতা ওলটালে এই ঐতিহাসিক সত্য আরো স্পষ্ট হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই সত্য আমরা ভুলে যেতে বসেছি। পণ্ডিত হর প্রসাদ শাস্ত্রী বাঙালিকে অভিহিত করেছিলেন ‘আত্মবিস্মৃত’ জাতি হিসেবে। এই আশঙ্কা আরেকবার মনে উঁকি মারে, যখন দেখি মানিক মিয়ার মতো একজন দেশপ্রেমিক খ্যাতিমান সাংবাদসেবীর জন্ম-মৃত্যু দিনে রাষ্ট্রীয় আয়োজন নীরব। আমাদের জাতীয় জীবন থেকে এই অনুদার ধারা কবে অপসৃত হবে?
সময়ের পথ পরিক্রমায় দৈনিক ইত্তেফাক এখন ৭০ বছরে পদার্পণ করেছে। ১৯৫৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর ইত্তেফাক আত্মপ্রকাশ করেছিল একটি দৈনিক পত্রিকা হিসেবে। একটি জাতির ইতিহাসে সত্তর বছর তেমন কোনো বয়স নয়, কিন্তু সংবাদপত্রের ইতিহাসে একটি সংবাদপত্রের সত্তর বছরকাল ধরে অব্যাহত প্রকাশনা বড় বিস্ময়কর। এটা কেবল কোনো সংবাদপত্রের দীর্ঘায়ুই নয়, পরমায়ুও বটে। ‘ঢাকা প্রকাশ’ নামক যে সাপ্তাহিক পত্রিকাটি উনিশ শতকের ষাটের দশক থেকে বিশ শতকের ষাটের দশক পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল এবং অনেক বার মালিকানা বদল সত্ত্বেও পত্রিকাটি শতবর্ষী হতে পেরেছিল, তা ছিল মূলত বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে একটি বিরল গৌরব। কিন্তু সময়ের ধকলে ঢাকা প্রকাশ টিকে থাকতে পারেনি। টিকে থাকতে পারেনি দৈনিক আজাদ। একটি বিশেষ ধারার রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা জোগাতে আজাদ পত্রিকার জন্ম। কিন্তু কালক্রমে সেই রাজনীতির আবেদন যেমন ফুরিয়েছে, পত্রিকার জনপ্রিয়তাও তেমনি হ্রাস পেয়েছে দিনে দিনে। ইত্তেফাক এ ক্ষেত্রে বরাবরই ব্যতিক্রম। ইত্তেফাক পত্রিকাটির জন্ম হয়েছিল একটি প্রত্যয় দৃঢ় অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে। মানিক মিয়া সম্পাদিত ইত্তেফাক ছিল একটি ‘মিশন’। গোড়া থেকেই একটি ‘কমিটমেন্ট’ ছিল ইত্তেফাকের। যে কারণে ইত্তেফাক পরিণত হয়েছিল পূর্ব বাংলার অধিকারবঞ্চিত জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী ‘কথা বলার ফোরাম’ বা ‘পিপলস্ পার্লামেন্ট’-এ। যখন প্রচলিত পার্লামেন্টে বঞ্চিত মানুষের পক্ষে কথা বলার কেউ ছিল না, তখন ইত্তেফাকই পরিণত হয়েছিল ‘জনগণের মুখপত্রে’।