আমাদের দেশে একটি বহুল উচ্চারিত, মিছিলপ্রিয়, শ্রুতিমধুর স্লোগান হচ্ছে : ‘অমুক তুমি এগিয়ে চলো/আমরা আছি তোমার সাথে। ’ জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন ইত্যাদিতে যেখানে স্থানীয় কোনো নেতার নেতৃত্বে কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, সাধারণত তাঁর নামেই এ ধরনের স্লোগান দেওয়া হয়। সম্প্রতি জাতীয় সংসদের গাইবান্ধা-৫ শূন্য আসনের উপনির্বাচনে ভোট চলাকালে মাঝপথে ভোটগ্রহণ স্থগিত হওয়ার পর আমার মনে হচ্ছে ‘নির্বাচন কমিশন তুমি এগিয়ে চলো, দেশবাসী আছে তোমার সাথে’ জাতীয় একটি স্লোগান দিতে দিতে মিছিল নিয়ে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের দিকে গেলেও যাওয়া যেত। তাতে অন্তত নির্বাচন কমিশনের কপালে যে এক যুগ ধরে প্রশংসার খরা এবং সমালোচনার বন্যা জেঁকে বসে আছে, সামান্য হলেও তার অবসান হতো।
কিন্তু তা হয়নি। কারণ গালমন্দ, খিস্তিখেউড়ে আমরা, মানে বাঙালিরা, যেমন পারঙ্গম, গুণগ্রাহিতার বেলায় তেমনি কোষ্ঠবদ্ধ। আবার নির্বাচন কমিশনের প্রশংসা করলে না জানি কোন দেবতা রুষ্ট হন তাও ভেবে দেখতে হয়। কাজেই আমার এক মরহুম শ্রদ্ধেয় চাচা মোবারক আলী সিদ্দিকী সাহেব আজ থেকে প্রায় ৬২ বছর আগে আমাদের সিলেট অঞ্চলের খাঁটি গ্রাম্য ভাষায় আমাকে যে উপদেশামৃত দান করেছিলেন তা বরং স্মরণ করি। তিনি বলেছিলেন : দ্যাখো ভাতিজা, সব সময় মনো (মনে) রাখিও, ‘দেখে, হুনে (শুনে), মাতে না (কথা বলে না), কুনু (কোনো) আপেদ (আপদে) পায় না। ’ ফলে গাইবান্ধা-৫-এর উপনির্বাচন হঠাৎ করে হার্টফেল করল, না স্ট্রোক করে মারা গেল, কাজটা ভালো হলো, না মন্দ হলো, এ ব্যাপারে ইদানীংকালে তৈল-তণ্ডুলের দুশ্চিন্তায় বিভোর ছাপোষা বাঙালি নাক না গলালেই ভালো। তবে এটাও ঠিক, বাংলাদেশের নির্বাচন ইতিহাসে এত বড় চমক এর আগে কখনো দেখা গেছে বলে মনে হয় না।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে যেসব আশ্বাস-বিশ্বাসের কথা জাতিকে শুনিয়ে আসছে তাতে তাদের ওপর অবশ্যই আস্থা স্থাপন করা যেত, যদি না তাদের অব্যবহিত পূর্বের দুই কমিশন দিনকে রাত এবং রাতকে দিন বলার অনন্য রেকর্ড স্থাপন করে যেত। তাদের কর্মকাণ্ডে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর থেকেই মানুষের মন উঠে গিয়েছিল। আমার কাছে কিন্তু বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাহেবের কথাবার্তা প্রথম থেকেই বেশ হৃদয়গ্রাহী মনে হয়। তিনি যখন একটি অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন জাতিকে উপহার দেওয়ার কথা বলেন, তখন তাতে আমি অন্তত আন্তরিকতার অভাব দেখি না। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন, যে নির্বাচনের নামে প্রহসন ছিল সেটা প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী আব্দুল আউয়াল সাহেব মনে হয় ভালোভাবেই উপলব্ধি করেন এবং সেই উপলব্ধি থেকেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যথাসম্ভব কলুষমুক্ত হোক, এটাই চান তিনি। তবে হ্যাঁ, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)-এর ব্যাপারে কেন জানি মনে হয় তাঁর দুর্বলতা আছে। কারণ ওই যন্ত্রটির সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করা এবং তা দূর করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ না করেই ৮/১০ হাজার কোটি টাকার মেশিন ক্রয়ের উদ্যোগ নেওয়া, সর্বোপরি বিজ্ঞজনদের নিষেধ উপেক্ষা করে তার ব্যবহার শুরু করার ভেতর কেমন জানি ‘আনডিউ হেস্ট’ (অনুচিত দ্রুততা) লক্ষ করা যায়। আমি মনে করি, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বসে আরো আলাপ-আলোচনা করে কাজটা করলে ভালো হতো।