বাঙালির গৌরবময় অনেক অর্জনই সম্ভব হয়েছে ঔপনিবেশিক এবং পাকিস্তানি আঞ্চলিক অধীনতার চাপের ভেতর। স্বাধীনতা কি বাঙালিকে উদ্যমশূন্য করে দিয়েছে? এটাও সত্য যে অধীন সময়ে অর্জনগুলো সিদ্ধ করে বাধ্য হয়েছিল বাঙালি। নানা রকম চাপ আসে। অন্যায়, অবিচার, শোষণ, অধিকার পূরণে নাভিশ্বাস ওঠে। উদ্ধারের জন্য বিদ্রোহী হতে হয় ভীরুতা আর জড়তা ত্যাগ করে। এই ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করেই বাঙালির ভাষা-বিদ্রোহ, স্বাধীনতা ও মুক্তি আন্দোলন, বাম বিপ্লবী পরিকল্পনার জন্ম। কিন্তু গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিচর্চাই হোক বা জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতিচর্চাই হোক, তা অবহেলিতই পড়ে থাকে। ভাষার ভাগ, স্বাধীনতার গান। তেভাগার গান তো সংস্কৃতির ক্ষুদ্রাংশে। বৃহৎ অংশটাই হলো মানসিক চর্চা। চৈতন্যের চর্চা। দর্শনের চর্চা। এসব হয়নি বলেই স্বাধীনতাপ্রাপ্তির মাত্র কবছরের ভেতরই স্বাধীনতার চার মৌলনীতি বাতাসে বিলীন হয়ে যায়। স্পষ্টই দেখা গেল প্রগতিবাদী সংস্কৃতিচর্চা, গণতন্ত্রের চর্চা এবং আধুনিকতা বা বৈজ্ঞানিক মূল্যবোধকে পেছনে ঠেলে দোর্দণ্ড প্রতাপে সামনে এসে দাঁড়ায় ক্ষমতার রাজনীতি।
একাত্তর-উত্তর আজকের চলমান সময়টার দৈর্ঘ্য তো কম নয়। একটি মাত্র শহর। ঢাকা শহর। বাঙালির হৃৎপিণ্ড, বাঙালির মস্তিষ্ক, চোখের কর্নিয়া, রক্তের শ্বেতকণিকা, মেরুদণ্ডের মজ্জা। সব জড়াজড়ি করে আছে নদী বুড়িগঙ্গা তীরের এই শহর। এই শহরের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তার ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখেছেন কিছুসংখ্যক প্রবীণ অধ্যাপক। তা ছাড়া অসংখ্য যে বিশ্ববিদ্যালয় রাতারাতি গজিয়ে উঠেছে এই নগরীতে, তাতে কি মনীষা চর্চার দুয়ার খুলল? শিক্ষার্থীদের কাগুজে ডিগ্রিদানের বা প্রাতিষ্ঠানিক লাভ লভ্যতা যত সহজ হচ্ছে, ততই দুষ্প্রাপ্য হচ্ছে জ্ঞানচর্চা। পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় বিজ্ঞান কিংবা অর্থশাস্ত্র, যারাই সেসব বিষয়ে নোবেল বা সমমর্যাদার আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক-শিক্ষক। একাত্তর-উত্তর নগর ঢাকাকে কেন্দ্র করে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় রাতারাতি গড়ে উঠেছে সেসব মোটেই জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি। জ্ঞানচর্চাকে গ্রাস করল শিক্ষা কেনাবেচার হাট।
তবুও রবীন্দ্রনাথের কাব্যভাষাকে পাল্টে বলতে হয় এই নগর ঢাকা জনগণমন অধিনায়ক বঙ্গবিধাতা। যত সীমাবদ্ধতা, যত দোষই থাকুক এই শহর বাংলাদেশের প্রাণ। ওই যে ঔপনিবেশিক বঞ্চনার শিকার হলো সে, ষোলোআনা উদ্ধার তার হলো না। ব্রিটিশ পতাকা, পাকিস্তানি পতাকা, স্বাধীন বাংলার পতাকা, তিনটি পতাকার সাক্ষী এই নগর ঢাকা। সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য এখানে পাশাপাশি বাস করে। গণতন্ত্রের সুবাতাসে মিশে থাকে স্বৈরতন্ত্রের বিষবায়ু। সংক্রামক ব্যাধির জীবাণু পূর্ণ নর্দমার পাশে শুয়ে আছে ঝাঁ চকচকে সড়ক। এই নগরেই রচিত হয় স্বাধীনতার স্বপ্ন এবং স্বাধীনতাবিরোধী চক্রান্ত। মহৎ শিক্ষার সঙ্গে মিশে আছে প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতি। বিজ্ঞানবাদের সঙ্গে সংঘাত বাধে মৌলবাদের। মার্কসবাদী বিপ্লবী তত্ত্বের সামনে দাঁড়ায় সামন্তবাদী তত্ত্ব। সারা দেশের গ্রাম-শহরকে অধীনে রাখে এই ঢাকা শহর। নাগরিক আগ্রাসন ঠেলে দেয় গ্রাম-মফস্বলে। রাজন্যবর্গ বা প্রতাপশালী শাসক শ্রেণির আবাসস্থল এই শহর। ধনী হওয়ার ‘যন্তর-মন্তরের’ গৃহ এই শহর। এখানেই রয়েছে গণশোষণের অস্ত্রাগার। কী বিচিত্র এই নগর! গণতন্ত্র হত্যাকারীদের পাশাপাশি বাস করে গণমুক্তির বিপ্লবীরা।