পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য শাপে বর হয়েছে। বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ, প্রকৌশলী, বিশেষজ্ঞ, কনসালট্যান্ট, আমলা, মন্ত্রী, যাঁরা তথাকথিত বিদেশি ‘সাহায্য’-এর নামে ঋণের নির্ভরতা বাড়াতে সব সময় ব্যস্ত থাকেন, ঋণ বা বিদেশি কোম্পানি ছাড়া এ দেশের পক্ষে কিছুই সম্ভব নয় বলে যঁারা অবিরাম ফাইল-রিপোর্ট তৈরি করেন, তাঁরাও এখন গলা ফাটিয়ে বলছেন, ‘আমরাও পারি।’ আর হীনম্মন্যতার জ্বরে আক্রান্ত মানুষও বুঝতে পারছেন, অনেক কিছুই তাঁদের পক্ষে সম্ভব। কিন্তু তাঁদের মনোযোগ যাতে আর কোনো দিকে না যায়, এর জন্য প্রচার বাহিনী নিয়োজিত আছে।
আসলে পদ্মা সেতু থেকে সরে গেলেও প্রাতিষ্ঠানিক ও মতাদর্শিকভাবে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-এডিবি গোষ্ঠী বাংলাদেশের সর্বত্র বিরাজমান। যেভাবে সরকার-আমলা-অর্থনীতিবিদসহ বিশেষজ্ঞরা বিশ্বব্যাংকীয় মতাদর্শ নিজের মাথায় শক্ত পেরেক দিয়ে গেঁথে নিয়েছেন, তাতে তাঁদেরও আর আলাদা করা যায় না। এই মতাদর্শের পোশাকি নাম ‘নব্য উদারনৈতিক’, যা পুঁজি সঞ্চয়নের উগ্র পথপ্রদর্শক। এর সারকথা হলো এ পৃথিবীর সবকিছুই ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবসা ও মুনাফার জন্য। যা কিছু মুনাফা করে, তা নদী বিনাশ করে হোক, সমুদ্র-বায়ুমণ্ডল, মানুষের শরীর নষ্ট করে হোক, যুদ্ধ বাধিয়ে হোক, তা–ই অর্থনৈতিক উন্নয়ন। এ দৃষ্টিভঙ্গিতেই বিশ্বব্যাংকের ঋণে ‘উন্নয়ন’ প্রকল্পে পাটশিল্প বিনাশ হয়েছে, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত দেশি–বিদেশি ব্যবসায়ীদের চারণক্ষেত্র বানানোর জন্য জাতীয় সক্ষমতার পথে বাধা বাড়ানো হয়েছে, শিক্ষা ও চিকিৎসা ব্যক্তি-গোষ্ঠীর ব্যবসার বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে, সর্বজন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যিক তৎপরতা বেড়েছে, রেশনব্যবস্থা বাতিল হয়েছে, খাদ্যগুদাম কমেছে, কোম্পানির বীজনির্ভরতা বেড়েছে। এ ধারাতেই বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় নৌপথ অর্ধেক হয়ে গেছে, রেলপথেরও বিকাশ হতে পারেনি, অন্যদিকে ঋণ প্রকল্পে সড়ক–মহাসড়ক বেড়েছে কয়েক শ গুণ। পানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম নিয়মিতভাবে বাড়ছে একই ধারায়।
পদ্মা সেতুর কাজ যেভাবে হয়েছে, তাতে মার্কিন, চীন, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের প্রযুক্তিজ্ঞান, দক্ষতা ও জনবল কাজে লাগানো হয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী নিজেদের কর্তৃত্ব রেখে অনেক ক্ষেত্রেই এভাবে কাজ করা যায়। কিন্তু লুটেরা আধিপত্য নিশ্চিত করতে এ পথ অন্য বহু ক্ষেত্রেই গ্রহণ করা হয় না। এখানে পদ্মা সেতুর কাজ শুরুর কয়েক বছর আগের একটি অভিজ্ঞতা খুবই প্রাসঙ্গিক।
২০০৯ সালে সরকার গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানে মার্কিন কোম্পানি কনোকো ফিলিপসের সঙ্গে চুক্তির সিদ্ধান্ত নেয়। এর এক দশকের বেশি সময় আগে থেকে আমরা জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ বিষয়ে সাত দফা দাবি নিয়ে বহুবিধ কাজ করছিলাম, যার মোদ্দাকথা ছিল দেশের সম্পদ ও প্রতিষ্ঠানের ওপর শতভাগ মালিকানা, জাতীয় সক্ষমতার ভিত্তিতে অনুসন্ধান ও উত্তোলন, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের উদ্যোগ গ্রহণ, গ্যাসসহ খনিজ সম্পদ রপ্তানি নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি। আমরা বিশ্লেষণ করে দেখলাম, কনোকোর সঙ্গে এই চুক্তি হলে আমাদের সমুদ্রসম্পদে কোম্পানির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে এবং কার্যত প্রাপ্ত গ্যাসসম্পদের বড় অংশই রপ্তানি হবে। আমরা তাই এর বদলে জাতীয় সংস্থার সক্ষমতা বাড়িয়ে এ কাজে হাত দিতে বললাম। সে সময় সরকারের বিভিন্ন উপদেষ্টা, মন্ত্রী, পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান, কোম্পানিমুখী বিশেষজ্ঞরা সবাই একসুরে বলতে থাকলেন, সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান অসম্ভব দক্ষতা আর বিপুল ব্যয়ের ব্যাপার। আমাদের পক্ষে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তা ছাড়া দ্রুত গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন দরকার।