আমি জিজ্ঞেস করলাম, হচ্ছেটা কী? শায়লা বলল, ছি ছি ছি! বুঝতে পারলাম, লজ্জায় মাথা কাটা গেছে! মার্কিন সংসদ ভবনে হামলা নিয়ে পুরো বিশ্ব এখন মুখর। ওদিন রাত জেগে একটা কনফারেন্স কলে ছিলাম। হঠাৎ করেই লাইভ স্ট্রিমিং-এ দেখতে পেলাম, হাজার হাজার মানুষ পঙ্গপালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে ক্যাপিটল হিলে। প্রথমে মনে করেছিলাম কোনো সিনেমার বিজ্ঞাপন হয়তো। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেলাম, এটা বাস্তব। কনফারেন্স কল মাথায় উঠল। কোনোরকমে কলটি শেষ করেই টিভি ছাড়লাম। সিএনএন, বিবিসি সবাই লাইভ দেখাচ্ছে। ঢাকায় বসে ওয়াশিংটন ডিসির লাইভ মুভি দেখছি যেন। জনতা ভবনটি আক্রমণ করেছে, আর অল্প কিছু পুলিশ তাদের ফেরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তা কী আর হয়! বন্যার পানির মতো মানুষ ঢুকে পড়েছে ভবনটির মূল কক্ষে। এমনকি স্পিকারের চেয়ারে বসে তামাশা করছে, সেই ছবিও লাইভে চলে এল। আমি ভাবলাম, কেউ কার্টুন বানিয়ে ছেড়েছে। একটু পর বুঝতে পারি, না ওটাও সত্যি! পুরো বিশ্বের মানুষ সেই ছবি দেখেছে। হঠাৎ করেই উৎকন্ঠা বেড়ে গেল। ঠিক এমন করেই আমি টিভিতে নাইন/ইলেভেন দেখেছিলাম। তখন আমি ক্যালিফোর্নিয়াতে। অস্টিন থেকে এক বন্ধু ফোন করে বলেছিল, ‘এখুনি টিভি খোল, দ্যাখ কী হচ্ছে।’ একই ভয়ে এবার আমি পালজড হয়ে বন্ধুদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, হচ্ছেটা কী? নাইন/ইলেভেনের সময় মানুষকে মরতে দেখেছিলাম। উঁচু ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ছিল মানুষ! এবার শঙ্কা ছিল, পুলিশের গুলিতে কতজন না মারা যায়! এই জনস্রোত থামানোর জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক কিছুই করতে হতে পারে। মানুষ যেভাবে স্পাইডারম্যানের মতো দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠে গেল, তাতে গুলি করা ছাড়া আর ঠেকানোর উপায় কী! নইলে ভেতরের মানুষগুলোর জীবন অরক্ষিত হয়ে যেতে পারে! ঘুম ছুটে গেল। একবার সিএনএন, আরেকবার বিবিসি নয়তো আল-জাজিরা। ওয়াশিংটন ডিসির মেয়র যখন কারফিউ ঘোষণা দিলেন, তখন একটু শান্ত হলাম। যাক, মানুষের মৃত্যু হয়তো ঠেকানো গেল। কারফিউ শুরু হলে যখন দেখতে পেলাম রাস্তাঘাট থেকে মানুষ সরে গেছে, তারপর ঘুমাতে গেলাম। সেটা বাংলাদেশ সময় প্রায় ভোর। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশটির সংসদ ভবনে এমন কিছু ঘটতে পারে, এটা কারো কল্পনাতেও ছিল না। পুরো পৃথিবীর মানুষ ছি ছি করছে এখন! সবাই জানেন, এই পাগলামির মূল কারণ হলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এখন তাকে সরানোর জন্য সবাই মুখর হয়েছেন। আমেরিকার গণতন্ত্রের মুখে তিনি যে কালি মেখে দিয়েছেন, এখন সবাই ভয় পাচ্ছে এই পাগল আর না কী ঘটিয়ে ফেলেন। যদিও প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার আছে আর মাত্র ১২ দিন। তবু সবাই ভয়ে আছেন। বিশেষ করে, প্রেসিডেন্টের কাছে পারমাণবিক বোমার চাবি আছে। স্পিকার দাবি করেছেন, সেই এক্সেসগুলো যেন এখনই বন্ধ করে দেয়া হয়!
দুই. পারমাণবিক বোমার এক্সেস বন্ধের দাবির আগেই অবশ্য প্রেসিডেন্টের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এক্সেস বন্ধ হয়ে যায়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইটার, ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দিয়েছে টুইটার এবং ফেসবুক কর্তৃপক্ষ। এর মূল কারণ হলো, এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেই ট্রাম্প তার ভক্তদের দিয়ে ক্যাপিটল হিল আক্রমণ করিয়েছিলেন। ট্রাম্প নিত্যদিন তার মিথ্যাগুলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো ব্যবহার করে। ওয়াশিংটন পোস্ট গত সপ্তাহে প্রকাশ করেছে, মিথ্যা তথ্য প্রকাশে ট্রাম্প রেকর্ড করেছেন। যদিও এক দিন পরেই টুইটার ট্রাম্পের অ্যাকাউন্ট আবার শর্ত সাপেক্ষে খুলে দিয়েছিল, কিন্তু ফেসবুকের সিইও মার্ক জাকারবার্গ এক পোস্টে বলেছেন, যত দিন না নতুন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতায় বসছেন, তত দিন ট্রাম্পের অ্যাকাউন্ট বন্ধ থাকবে। প্রয়োজনে তার অ্যাকাউন্ট আজীবনের জন্য ব্লক করে দেয়া হবে! প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে টুইটের মাধ্যমে মানুষকে ক্যাপিটল হিলে আসতে বলেছিলেন, সেই টুইটটি তিনি মুছে ছিয়েছেন। এবং তারপর নতুন টুইটে ঘোষণা দিয়েছেন যে শান্তিপূর্ণভাবে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। বোঝাই যাচ্ছে, এই কঠিন শর্তে টুইটার তার অ্যাকাউন্টটি খুলে দিয়েছে। নয়তো চিরদিনের জন্য ট্রাম্প টুইটার অ্যাকাউন্টটি হারাতেন। টুইটার কর্তৃপক্ষ বলেছে যে প্রতিষ্ঠানটি ট্রাম্পের ক্ষতিকর পোস্টগুলো দেখছিল; এবং তিনি যদি এটা করতেই থাকেন, তাহলে তার এক্সেস পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হবে। এই গ্রহের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষটির ফেসবুক এবং টুইটার অ্যাকাউন্ট যখন বন্ধ করে দেয়া হয়, তখন তার সঙ্গে অন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোও যুক্ত হয়। স্ন্যাপচ্যাট ট্রাম্পের এক্সেস বন্ধ করে দেয়। ইউটিউব নির্বাচনসংক্রান্ত তাদের নীতিমালা এমনভাবে প্রণয়ন করে, যেন খুব সহজেই ট্রাম্পের অ্যাকাউন্টটি আইনগতভাবে বন্ধ করে দিতে পারে; কারণ ট্রাম্প ভুয়া নির্বাচনী তথ্য প্রচার করছিলেন। আরেকটি ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ট্রাম্পের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেয়।
তিন. ওপরের ঘটনাগুলো আপনারা সবাই জানেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং টিভিতে এখন সবাই মজা দেখছেন, এমন মজা লাইফ টাইমে তো আর পাওয়া যাবে না। সবাই যখন আমেরিকার বর্তমান অবস্থা নিয়ে মজা করছেন, তখন আমি ভাবছিলাম, একজন প্রেসিডেন্টের এক্সেস বন্ধ করার মতো সাহস দেখাতে পারবে কোনো দেশের কোম্পানি? যদিও আইনজীবীরা এবং ফেসবুকের কর্মীরাও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন যে, কেন ট্রাম্পের এক্সেস আরো আগেই বন্ধ করা হয়নি তা নিয়ে, কিন্তু তারপরেও তিনি এখনো সিটিং প্রেসিডেন্ট। এখনো তার ক্ষমতা রয়েছে। যদিও তাকে মাত্র ১২ দিন পরেই হোয়াইট হাউস ছাড়তে হবে, তবু এই ১২ দিন অনেক সময়! আসলেই কেউ আমাকে বলতে পারবেন, এই বিশ্বের আর কোনো দেশের কোনো প্রতিষ্ঠান সেই দেশের বর্তমান প্রেসিডেন্টের এক্সেস বন্ধ করে দেয়ার মতো সাহস কিংবা ক্ষমতা রাখে? আছে কোনো দেশ? আমরা যতই হাসাহাসি করি, কেউ কি একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখেছেন, কী সাংঘাতিক ক্ষমতাধর হয়ে উঠেছে এই কোম্পানিগুলো। তারা চাইলেই কোনো একজন ক্ষমতাশালী ব্যক্তিকে মুহূর্তেই জিরো করে দিতে পারে। এখানে কার ক্ষমতা বেশি? ট্রাম্প নাকি জাকারবার্গ? এই বিষয়ে হোয়াইট হাউসের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহারে ট্রাম্পের চেয়ে সফল আর কোনো প্রেসিডেন্ট ছিলেন না। কিন্তু এটাই এখন কঠিন সত্য যে ট্রাম্প যখন দেশের ক্রান্তিলগ্নে কথা বলতে চাইছেন, তখনি বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো তার মন্তব্য সেন্সর করছে, নয়তো তাকে পোস্ট করতে বাধা দিচ্ছে। বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এই কঠিন সিদ্ধান্ত যখন নিতে হচ্ছিল তখন নিজেদের ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেমে মার্ক জাকারবার্গ কর্মীদের বলছিলেন, শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া গণতন্ত্র সচল থাকতে পারে না। তিনি আরো বলছিলেন, বর্তমান প্রেসিডেন্ট কীভাবে তাদের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে একটি নতুন নির্বাচিত সরকারকে বানচাল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মার্ক জাকারবার্গ তখনি ট্রাম্পের পেজ থেকে দুটি পোস্ট মুছে দেয়ার নির্দেশ দেন। আমার মাথায় শুধু এটাই ঘুরছে, দুটো প্রতিষ্ঠান কীভাবে এই সাহস দেখাতে পারল! টুইটার সরাসরি বলেই দিয়েছিল যে, ওই বিতর্কিত দুটো টুইট সরিয়ে না নিলে ট্রাম্প তার এক্সেস সারা জীবনের জন্য হারাবেন। মাত্র ১২ ঘণ্টার মাথায় সেই শর্ত ট্রাম্পকে মেনে নিতেই হয়েছে। এটা কীভাবে সম্ভব! মানুষ যতই আমেরিকাকে গালি দিক, কিন্তু আমি তো জানি কি কঠিন সিদ্ধান্ত এটি! এই গ্রহের আর কোনো দেশ নেই, যেখানে এই কাজটি করা যেতে পারে। এবং এই একটি কারণেই আমার আবার আমেরিকা যেতে ইচ্ছে করে! ফ্রিডম, আহ ফ্রিডম!
পুনশ্চ: লেখাটি যখন পাঠাব, তখন সংবাদ এসেছে টুইটার ডোনাল্ড ট্রাম্পের অ্যাকাউন্ট পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে, যেখানে প্রায় ৯ কোটি ফলোয়ার ছিল!