বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নতুন নির্বাচনের দাবিতে ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ ঘোষণা করেছেন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের অন্যতম শরিক লিবারেল ডেমক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্নেল ড. অলি আহমেদ। বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন থেকে এই ঘোষণা দেন তিনি। জাতীয় মুক্তি মঞ্চ জাতির দুরবস্থা ও জাতীয় সমস্যা সমাধানে কাজ করবে বলে সরকারের উদ্দেশ্যে ১৮ দফা দাবি পেশ করেন তিনি। দাবিগুলো হল- ১। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদের পুননির্বাচন- গত ৩০শে ডিসেম্বর, ২০১৮ সালে ঘটে যাওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইতিহাসের একটি নির্মমতম রাষ্ট্রীয় প্রতারণা, সর্বকালের নিকৃষ্ট জাতীয় বেঈমানী ও প্রহসনের মাধ্যমে নির্বাচন নামের নাটক সৃষ্টি করে, জনগণের ভোটের অধিকার হরণ করা হয়েছে। জনগণকে ভোটের অধিকার এবং ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ফলে সমগ্র জাতি মানসিকভাবে চরম আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জনগণের উপর অমানবিক নির্যাতন ও হয়রানি করা হয়েছে। পক্ষান্তরে ৩০শে ডিসেম্বর, ২০১৮ সালে দিনের বেলা কোন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নাই। বরং ২৯শে ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত্রি বেলা ৬০-৭০% ব্যালট পেপার কেটে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয়। এই নির্বাচনে ভোটার ছিল পুলিশ ও প্রশাসনের সদস্যবৃন্দ। তাদের প্রার্থী ছিল আওয়ামী লীগের নেতা। কোন অবস্থাতেই এই নির্বাচন এবং এই নির্বাচনের ফলাফল জনগণ গ্রহণ করে নাই। বর্তমান সরকার জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির দ্বারা গঠিত হয় নাই এবং এতে জনগণের অংশগ্রহণও নাই। অতএব, জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দেশের এবং দেশের জনগণের মঙ্গলের জন্য আমরা জাতীয় সংসদের পুননির্বাচনের জোর দাবী জানাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে যত দ্রুত সম্ভব নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের তত্ত্বাবধানে পুননির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তারিখ ঘোষণা করতে হবে।২। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তির দাবি ঃ- তাঁর বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সাজানো মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার। তিন বারের সফল প্রধানমন্ত্রী, একজন প্রবীন রাজনীতিবিদ, সাবেক সেনা প্রধান ও রাষ্ট্রপতি এবং মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাকারীর স্ত্রী। মিথ্যা মামলার নামে তাঁকে হয়রানি, সাজানো বিচারে আটক করে, আর্থিক-শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করা হচ্ছে। এটি একটি গর্হিত কাজ। এতে সরকারের প্রতিশোধ পরায়ণতার প্রমাণ বিদ্যমান। ৩। দেশবিরোধী চুক্তি প্রকাশের দাবি- বিগত দশ বছরে তথা বর্তমান অবৈধ সরকারের সময়ে, যে সকল দেশবিরোধী চুক্তিতে অসম প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে। ৪। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রক্ষার দাবি- ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দেশের জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে, যে সমস্ত মেগা প্রকল্প এবং স্পর্শকাতর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে, তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। ৫। জাতীয় বিশেষজ্ঞ কমিশন গঠনের দাবি- সাম্প্রতিককালের ভয়াবহ জাতীয় অর্থনৈতিক কেলেংকারী যথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, ব্যাংক ডাকাতি, শেয়ার মার্কেট লুটপাট, অর্থ পাচার ইত্যাদি অপকর্মের কারণে দেশে অর্থনৈতিক নীরব দুর্ভিক্ষ, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, শিক্ষিত যুবকদের বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের অশনি সংকেত দেখা দিয়েছে। এই ধরণের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে এবং ভবিষ্যতে যেন তার পুনরাবৃত্তি না হয়, তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের নেতৃত্বে এক বা একাধিক জাতীয় বিশেষজ্ঞ কমিশন গঠন করতে হবে। কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে উক্ত সমস্যাগুলির সমাধান এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।৬। দেশের শিক্ষিত যুবকদের নিয়োগে অগ্রাধিকারের দাবি- দেশে শিক্ষিত যুবকদের বেকরত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বেকারত্ব হ্রাস করার লক্ষ্যে, কারিগরি শিক্ষাকে আরও বেশি সম্প্রসারণ করার নিমিত্তে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এই বেকারত্ব হ্রাস করার লক্ষ্যে প্রশিক্ষিত জনশক্তি বিদেশে রপ্তানীর জন্য কুটনৈতিক ও ব্যবসায়িক পদক্ষেপ জোরদার করতে হবে। এছাড়াও দেশের ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেশের শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত যুবকদের নিয়োগ নিশ্চিত করার জন্য আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ৭। গুম ও খুন বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি- দেশের সর্বত্র চরম বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য বিরাজ করছে। এই অবস্থা কারো কাম্য নয়। ন্যায় বিচার, সুশাসন এবং সাংবিধানিক অধিকার না থাকায় জনগণ হতাশাগ্রস্থ। বর্তমান সরকারের আমলে গুম, খুন, গুপ্তহত্যা, মাদক এবং ধর্ষণ মহামারি আকার ধারণ করেছে। জনগণের সরকার ব্যতীত এই ধরনের সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। এই ধরণের কর্মকা- বন্ধ করার জন্য অনতিবিলম্বে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং জনগণকে আশ্বস্ত করতে হবে। ৮। ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি- অবৈধ পন্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠান, অনৈতিক ও নির্মম ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রকে হত্যা করার নীল নকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে, বিরোধী দলীয় নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশে দায়েরকৃত গায়েবী মামলা, মিথ্যা মামলা, ষড়যন্ত্র মূলক রাজনৈতিক মামলা, অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্থদেরকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। ৯। লিগ্যাল এইড কমিটি গঠনের ষোঘণা- আমরা ঘোষণা করছি যে, আমাদের পক্ষ থেকে আগামী তিন মাসের মধ্যেই প্রতি জেলায় ‘লিগ্যাল এইড’ কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটির মাধ্যমে বিরোধী দলের নেতা/কর্মীদের মামলাগুলি পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব, আমরা বহন করব। সুতরাং নেতা/কর্মীদের কোন সমস্যা হবে না। ১০। প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ও হয়রানী বন্ধের দাবি- বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে বাধা দান এবং বিদেশ গমনের সময় বিমান বন্দরে অহেতুক হয়রানি বন্ধ করতে হবে।১১। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন, ভেজাল ও নকল ঔষধ বন্ধের দাবি- দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভঙ্গুর। রাষ্ট্রপতিসহ চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর দেশের কেউ আস্থা রাখতে পারছে না। বিধায়, বিত্তবান প্রায় সকলেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং ভারতে চিকিৎসার জন্য অহরহ যাতায়াত করছে। এতে করে দেশের অর্থনীতিতে এবং চিকিৎসা ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নতির লক্ষে সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ভেজাল ও নকল ঔষধ উৎপাদন ও বিপনন বন্ধের লক্ষে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। ১২। খাদ্যে ভেজালকারীদের মৃত্যুদ- দাবি- ভেজাল খাদ্য মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। নতুন আইন করে ভেজাল খাদ্য সরবরাহের সাথে যারা জড়িত তাদের জন্য মৃত্যুদ-ের ব্যবস্থা করতে হবে।১৩। কৃষক যেন ন্যায্যমূল্য পায় তার দাবি- অধিক ধান ফলনের কারণে বর্তমানে কৃষকরা দুর্দশাগ্রস্থ, এই ধরণের পরিস্থিতি কারো জন্য কাম্য নয়। প্রতি বৎসর নিয়মিতভাবে সরকারের পক্ষ থেকে ধান সংগ্রহ করার লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ এবং কৃষককে ন্যায্য মূল্য প্রদানের লক্ষ্যে ধানের উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ করতে হবে এবং সেই মূল্য যেন সরেজমিনে কৃষক পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। ১৪। অর্থনৈতিক সমতা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি- জনগণের আয় ও ব্যয়ের সাথে কোন সামঞ্জস্য না থাকায় সমাজ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে এবং সর্বত্র সামাজিক অবক্ষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নি¤œমধ্যবিত্ত এবং গরীবদের মধ্যে নীরব দুর্ভিক্ষ চলছে। এই ধরণের সোনার বাংলার জন্য জাতি মুক্তিযুদ্ধ করে নাই। সমাজে অর্থনৈতিক সমতা এবং সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, প্রয়োজনীয় সঠিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ১৫। জাল ভোট প্রদানকারী ও সাহায্যকারীদের শাস্তি দাবি- জনগণের ভোটের অধিকার, সুশাসন এবং সর্বোপরি সকলের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। জাল ভোট প্রদান বা প্রদানকারীদের সাহায্য করার সাথে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত তাদের জন্য ন্যূনতম ১০ বছর সশ্রম কারাদন্ডের ব্যবস্থা রাখতে হবে। ১৬। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল দাবি ও বন্ধ করে দেওয়া মিডিয়া খুলে দেওয়ার দাবি- ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে সংসদে পাশকৃত “ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ২০১৮”- কালো আইন হিসেবে বাতিলের দাবী করছি। এই আইনের মাধ্যমে জনগণের কণ্ঠ রোধ করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে যে সকল সংবাদপত্র, টেলিভিশন এবং জনপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, তা অবিলম্বে খুলে দিতে হবে। ১৭। দুর্নীতি দমন আইনের বৈষম্য দূরীকরণের দাবি- বর্তমান দুর্নীতি দমন আইনে দারুণ বৈষম্য রয়েছে। এই আইন শুধু অসহায় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হচ্ছে। আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রীসহ সকল নাগরিকের বিরুদ্ধে দুদক স্বাধীনভাবে প্রয়োজনে তদন্ত করতে পারবে ও মামলা করতে পারবে, এই ধরণের বিধান রেখে আইন সংশোধন করতে হবে। দেশের সকল নাগরিকের জন্য আইন সমানভাবে প্রযোজ্য হতে হবে (শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় এই আইন তাঁর জন্য প্রযোজ্য হবে না)। ১৮। রাজনৈতিক দলগুলির জন্য সাংবিধান অনুযায়ী সুযোগ সৃস্টির দাবি- প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকে সাংবিধানিক পন্থায়, বিনা বাধায় নিজ নিজ দলের কর্মকান্ড পরিচালনা করতে দিতে হবে। শান্তিপূর্ণ মিছিল ও জনসভা করার সুযোগ দিতে হবে।