হাঙ্গেরীয় নাট্যকার ফ্রিটজ করিন্থির নাটক ‘রিফান্ড’ (পার্সিভাল ওয়াইল্ড অনূদিত)-এর গল্প দিয়ে শুরু করছি। বছর চল্লিশের ওয়াসারকফ আঠারো বছর পর স্কুলে ফিরে গিয়ে ছাত্রজীবনে দেওয়া সমুদয় টিউশন ফি ফেরত চায়। যুক্তি দিয়ে জানায়, স্কুলে সে কিছুই শিখতে পারেনি, যা দিয়ে জীবনে কিছু করা সম্ভব এবং নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে আরও বলতে শোনা যায়, এর দায় স্কুল আর স্কুলের শিক্ষকদের।
দেশে করোনার সময়টি বাদ দিয়ে (বিবেচনার কথা বলছি) বলছি, প্রতিবছর এসএসসি ও দাখিল পরীক্ষার ফলাফল দেখে কি কখনো ভেবেছেন, অকৃতকার্য হচ্ছে কারা এবং কেন? কয়েক বছর লক্ষ করার পর জানলাম, তাদের নব্বই ভাগই অকৃতকার্য হয়েছে গণিত আর ইংরেজিতে। এটি সেই অর্থে কোনো পরিসংখ্যান নয়, তবে কতগুলো স্কুল থেকে নেওয়া রেকর্ডদৃষ্টে বলা। এর মধ্যে গ্রাম ও শহর, দুই প্রান্তের স্কুল আছে। ছাত্রকালে শুনেছি, শহরের ছেলেমেয়েরা অঙ্কে ভালো নয়। গ্রামের ছেলেমেয়ে ইংরেজিতে দুর্বল। আমার অভিজ্ঞতায় শহরের ছাত্রছাত্রী অঙ্কে দুর্বল, সেটি হুবহু মেলেনি, তবে ইংরেজিতে ভালো। আর গ্রামের ছাত্রছাত্রী অতীতে কী ছিল জানি না, তবে এখন ইংরেজি বা অঙ্ক, একটিতেও ব্যতিক্রম ছাড়া সমানতালে এগিয়ে নেই। কেন এমন হচ্ছে?
একদা ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন দেখে ভালো লাগত না। পরে দেখলাম, ওখানে একটা কাজ হচ্ছে-ইংরেজিভীতির নিরাকরণ, যার প্রভাবটা হাইস্কুলে লক্ষণীয়। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় খাতের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থা কী? ইংরেজি আর গণিতের যে ভয় বাসা বাঁধে বালককালে-আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা সেটা দূর করছে কি?
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার জেলা প্রশাসক ডেকে বললেন, এত-শত প্রার্থীর মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া তো দুরূহ; সব কাজই যে আটকে যাবে। বললাম, আস্থা রাখুন, হয়ে যাবে। পাঠক, শিক্ষায় অগ্রসরমান একটি জেলার কথা বলছি। প্রাথমিকের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার মৌখিক বোর্ড। সে যায়, সে যায় না, সে কি যায়, সে কি যায় না; এর ইংরেজি বলা এবং এমনতর প্রশ্ন প্রার্থীদের জন্য। আর দশমিক থেকে সাধারণ ভগ্নাংশে এবং সাধারণ ভগ্নাংশ থেকে দশমিকে রূপান্তর কিংবা ভগ্নাংশের ছোট ছোট যোগ-বিযোগ। এবং এ রকমের ছোটখাটো প্রশ্ন। দশজনে একজনও পারছিল না। জেলা প্রশাসক প্রচণ্ড বিরক্ত, পারলে আমায় উঠিয়ে দেন বোর্ড থেকে। ডিপিও বিব্রত-দুই কারণ; এক. উঠিয়ে দিলে এ পরীক্ষা শেষ করা কঠিন হবে। দুই. প্রার্থীরা এসব সাধারণ প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারছে না। বোর্ডের সভাপতি রেগে বললেন, করছেন কী, এরা কমপক্ষে উচ্চমাধ্যমিক পাশ, অধিকাংশ গ্র্যাজুয়েট এবং স্নাতকোত্তর আর লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এসেছে। বললেন, এ তো বাচ্চাদের প্রশ্ন। বললাম, একটু ধৈর্য ধরুন, দেখুন, স্যার। জনাবিশেকের মধ্যে দু’জনও যখন এ বাচ্চাদের প্রশ্নই পারছিল না, তখন বোর্ডের প্রধান মাথায় হাত দিলেন। বললেন, এতটা খারাপ অবস্থা? জি, মহোদয়। আপনি শেষ কবে স্কুলে গিয়েছেন জানি না, কিন্তু আমি একরকম প্রতি সপ্তাহেই স্কুলে যাই। ততক্ষণে আমার অফিস কক্ষ থেকে থ্রি-ফোর-ফাইভের গণিত ও ইংরেজির বই চলে এসেছে। জেলা প্রশাসকের সামনে মেলে ধরলাম, বললাম, চাকরি পেলে এসবই শেখাতে হবে কোমলমতি শিশুদের। জেলা প্রশাসক মৌখিক পরীক্ষার ক’দিনে একরকম চুপই ছিলেন। বুঝলাম, ইঞ্জিনিয়ার; ভালো ছাত্র ছিলেন। নিজের সন্তান ইংরেজি স্কুলে পড়ছে। মানলাম, এই দৃশ্যে তিনি কষ্ট পেয়েছেন।