মানুষের জীবনে ধন-সম্পদ আর সুখের মধ্যে প্রায়ই একটি জটিল সম্পর্ক বিদ্যমান থাকে। কেউ যদি প্রশ্ন করে, "আপনি ধনী হতে চান, না সুখী?" উত্তরটি খুবই সহজ। আমরা সবাই ধনী হতে চাই, একইসঙ্গে সুখীও হতে চাই। কিন্তু, ধনী হওয়ার কারণ কী? অধিকাংশ মানুষ বলে থাকেন, "আমি ধনী হতে চাই কারণ আমি সুখী হতে চাই।" এখানেই শুরু হয় দ্বিধা। ধনী হলে কি মানুষ সত্যিই সুখী হয়? ধন কি সুখের একমাত্র উৎস? এই প্রশ্নগুলো আমাদের মানসিক অবস্থার উপর গভীর প্রভাব ফেলে।
বিশ্বব্যাপী অনেক গবেষণা বলছে, ধন আর সুখের মধ্যে সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। উদাহরণস্বরূপ, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১০ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যখন কোনো ব্যক্তির আয় তার মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হয়, তখন তার সুখের স্তর বৃদ্ধি পায়। তবে, আয় একটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে অতিরিক্ত ধন আর সুখের মাত্রা বাড়ায় না। এই গবেষণায় বলা হয়, $৭৫,০০০ বা তার বেশি আয় হলে মানুষের সুখে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রভাব দেখা যায় না। এর চেয়ে বেশি আয় করলেও সুখের স্তর স্থিতিশীল থেকে যায়।
তাহলে কেন ধনী মানুষ সুখী হতে ব্যর্থ হন? বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের মনোজগতই সুখের আসল উৎস। অর্থসম্পদ একমাত্র সুখের কারণ হতে পারে না। ধনী মানুষদের জীবনে বিভিন্ন কারণে মানসিক চাপ ও উদ্বেগ বাড়তে থাকে, যা তাদের সুখকে দূরে সরিয়ে দেয়। যাদের আয় বেশি, তাদের মধ্যে অসন্তোষ এবং অতৃপ্তি বেশি থাকে। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ এর গবেষণায় বলা হয়েছে, "যাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেশি, তাদের মানসিক চাপও বেশি হয়, কারণ তারা নিজেদের সম্পদের সঠিক ব্যবহার নিয়ে দুশ্চিন্তা করে থাকে"।
একটি প্রচলিত মিথ্যা ধারণা হলো— ধনই সুখের মূল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ধন শুধু আমাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ সন্তুষ্টি বা মানসিক শান্তি দিতে পারে না। সুখ আসলে একটি মানসিক অবস্থা, যা আমাদের মনের মধ্যে বিদ্যমান। ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট। অনুযায়ী, ধন-সম্পদ কোনো দেশের মানুষের সুখের প্রধান অনুঘটক নয়। যেমন, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে এবং ডেনমার্কের মতো দেশগুলো বিশ্বের শীর্ষ সুখী দেশগুলোর মধ্যে থাকলেও, তাদের মাথাপিছু আয় অনেক ধনী দেশের তুলনায় কম। এই দেশগুলোতে মানুষের সুখের মূল কারণ হলো সামাজিক নিরাপত্তা, ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং জীবনের মানের উপর তাদের সন্তুষ্টি।
ধনী হওয়ার পথে অনেকে পারিবারিক সম্পর্ককে অবহেলা করে ফেলেন। অর্থোপার্জনের জন্য তারা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো কমিয়ে দেয়, যা তাদের মানসিক শান্তি থেকে দূরে রাখে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, "ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে মানসিক চাপের অন্যতম কারণ হলো ব্যক্তিগত সম্পর্কের অবনতি" (Oxford University, 2021)। পরিবার হলো সুখের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদি আপনার পারিবারিক সম্পর্ক ভাল না থাকে, তাহলে আপনি অর্থের মাধ্যমে স্থায়ী সুখ পেতে পারবেন না।
সুখী হওয়ার জন্য আমাদের মনের প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থ আমাদের জীবনের একটি অংশ, কিন্তু তা আমাদের পুরো জীবন নয়। যদি আপনি মনে করেন যে আপনি প্রচুর অর্থোপার্জন করলেই সুখী হবেন, তবে আপনি ভুল করছেন। সুখী হওয়ার জন্য প্রথমে আপনার মনের স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। আমাদের মন এক ধরনের অভ্যন্তরীণ প্রশান্তি খোঁজে, যা কেবল ধন দিয়ে পূরণ করা যায় না। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এর ২০২০ সালের গবেষণায় বলা হয়েছে, "মনের প্রশান্তি এবং জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক চিন্তা মানুষকে দীর্ঘমেয়াদী সুখ দেয়, যা অর্থ বা সম্পদ কখনোই দিতে পারে না।"