হ্যাচ-বার্নওয়েল ছিলেন একজন ইংরেজ আইসিএস অফিসার। চাকরিতে ঢুকেছিলেন ১৯৩৩ সালে। প্রথমে কাজ করেছেন ব্রিটিশ বাংলায়। ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে চলে আসেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। পরবর্তী সময় ১৯৬৬ সালে মেম্বার, বোর্ড অব রেভিনিউ পদ থেকে অবসর গ্রহণ করে নিজ দেশ ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তন করেন। হ্যাচ-বার্নওয়েল ছিলেন দক্ষ আমলা। কাজ করতে গিয়ে এখানকার মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। তার দক্ষতা ও সহৃদয়তার পরিচয় পাই, ১৯৫৬ সালে খাদ্য বিভাগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও স্থায়ীকরণে তার অনবদ্য ভূমিকার মধ্য দিয়ে। ‘শেষ অভিভাবক’ শিরোনামে একটি অসাধারণ স্মৃতিকথা লিখে গেছেন। চাকরি জীবনের অসংখ্য অসাধারণ অনুকাহিনি বইয়ে স্থান পেয়েছে। সেখান থেকে কয়েকটি এখানে তুলে ধরা হলো
সে সময় আইসিএস অফিসারদের মধ্যে যাদের অপেক্ষাকৃত কম দক্ষ মনে করা হতো, তাদের বিচার বিভাগে চালান করার ব্যবস্থা নেওয়া হতো। নোয়াখালী জেলায় সে রকম একজন বিচারক নিয়োজিত ছিলেন। অনেক দিন চাকরি করার পরও সেখান থেকে তার বদলি হচ্ছিল না। সহকর্মীদের সঙ্গেও তার তেমন সখ্য ছিল না। একবার গভর্নর সেখানে পরিদর্শনে যান। সে সময় তিনি নিজের বদলির জন্য তার কাছে তদবির করেন। কিন্তু গভর্নর সেটা আমলে নেন না। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে গভর্নরকে কৌশলে শায়েস্তা করতে সুযোগ খুঁজতে থাকেন। কিছুদিন পর তার আদালতে একটা গুরুত্বপূর্ণ হত্যা মামলা আসে। সে মামলায় জেলার এসপি মামলাটি এমনভাবে সাজান, যাতে তার সত্যের অপলাপের প্রয়াস সামনে চলে আসে। বিচারক এই মামলায় তার অপছন্দের দুই ব্যক্তি গভর্নর ও এসপি এই দুজনকে ঘায়েল করার ব্যবস্থা নেন। প্রথমে তিনি মামলাটা নিখুঁতভাবে পর্যালোচনা করেন এবং রায় লেখার পর্যায়ে উপনীত হন। এরপর শপথ ভঙ্গের অভিযোগে এসপিকে জেলে তোলেন। এসপি যাতে কোনো ক্রমেই তাড়াতাড়ি জামিন না পান, তা নিশ্চিত করতে তিনি মামলার সব রেকর্ডপত্র জেলার সবচেয়ে অগম্য হাতিয়া মুন্সেফ আদালত পরিদর্শন করতে যান। উদ্দেশ্য ছিল, এসপিকে বেশি দিন জেল খাটানো এবং মামলার রায় লিখে গভর্নরকে জব্দ করা।
বিচার বিভাগ তাদের কাজে সবসময়ই স্বাধীনতা ভোগ করে। এই সুযোগে তিনি রায় লেখার সময় ভারতীয় দণ্ডবিধির নানা উদাহরণ নিপুণভাবে তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে গোপনে কিস্তিতে কিস্তিতে রায়টা কলকাতার প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। সেখানে মামলার একপক্ষ কর্র্তৃক চিহ্নিত অপর পক্ষের দুজন সাক্ষীর আপাত-বিরোধী সাক্ষ্যের একটা দৃষ্টান্ত ছিল। যেমন জনাব ক বলেছেন যে, কাজটা সংঘটনে জনাব খ-এর বিশেষ ভূমিকা ছিল। আবার জনাব গ বলেছেন যে, আসলে ঐ কাজটাতে জনাব ঘ-এর ভূমিকা ছিল। আসলে খ ও ঘ-এর মধ্যে কোনো অমিল ছিল না। প্রথম নামটা ছিল ব্যক্তিটির আনুষ্ঠানিক নাম, আর দ্বিতীয়টা ছিল গ্রামে প্রচলিত ডাক নাম। ক্ষুব্ধ বিচারক এই উদাহরণটা টেনে দুজনের আপাত অমিলটাকে মিল করতে রায়ে লেখেন যে, যেমন আমাদের গভর্নর মহোদয় আনুষ্ঠানিক পরিমণ্ডলে ‘স্যার ভি ডব্লিউ’ বলে আখ্যায়িত হয়ে থাকেন। কিন্তু যারা তাকে ভালোভাবে চেনেন, তারা তাকে তৈল-মর্দন-প্রিয় ‘পিছলা শ্যাম’ নামেও অভিহিত করেন। বিচারক এভাবে তার অনাক্রম্যতার ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে দাম্ভিক গভর্নরের ওপর প্রতিশোধ নিয়েছিলেন।