সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্রের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না এবং এটি নিয়ে এখন তুলকালাম চলছে। গণঅভ্যুত্থানের মুখে সরকারের পতন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের আড়াই মাস পরে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্রের হদিস নিয়ে এই আলোচনার সূত্রপাত মূলত মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেওয়া রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের একটি সাক্ষাৎকার—যেখানে তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের কোনও দালিলীক প্রমাণ তার (রাষ্ট্রপতি) কাছে নেই।
প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র ইস্যুতে রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্য নিয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হলো, সেটি কিছু সাংবিধানিক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যেমন:
১. শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র কোথায়?
২. এই ইস্যুতে কেন এখন রাষ্ট্রপতিরও পদত্যাগের দাবি উঠছে?
৩. রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যই কি এই বিতর্কটি উসকে দেওয়া হলো?
৪. রাষ্ট্রপতিকে যদি পদত্যাগ করতে হয় তাহলে তিনি কার কাছে পদত্যাগ করবেন? কেননা সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করতে হয় স্পিকারের কাছে। কিন্তু এ মুহূর্তে স্পিকার নেই। ডেপুটি স্পিকার কারাগারে।
৫. রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে নতুন রাষ্ট্রপতি কে হবেন?
৬. রাষ্ট্রপতি কীভাবে নির্বাচিত হবেন? কেননা রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দেওয়া হয় সংসদে। এখন সংসদও নেই।
৭. যদি রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করেন এবং কাউকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা না যায় তাহলে এই শূন্যতা পূরণ হবে কী করে? বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক কাজই করতে হবে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে। সুতরাং রাষ্ট্রপতি না থাকলে সেই কাজগুলো কীভাবে হবে?
৮. অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কি রাষ্ট্রপতি হয়ে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা চালু করবেন? যদি তাই হয়, তাহলে তিনি কোন প্রক্রিয়ায় বা সংবিধানের কোনও অনুচ্ছেদবলে রাষ্ট্রপতি হবেন—কে তাকে নির্বাচিত করবে?
প্রসঙ্গত, গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ওইদিন রাতেই জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন: ‘আপনারা জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি।’ (প্রথম আলো, ৬ আগস্ট ২০২৪)।
কিন্তু সম্প্রতি দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, তিনি শুনেছেন যে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। তবে তার কাছে এর কোনও দালিলিক প্রমাণ নেই। বলেন, পদত্যাগপত্র সংগ্রহ করার বহু চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তিনি হয়তো সময় পাননি।
যদি তাই হয় তাহলে ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি কেন বললেন যে, শেখ হাসিনা আজ রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি? তিনি কি ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানের মুখে ওই কথা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন?
মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার যখন বঙ্গভবনে এলেন তখন জানার চেষ্টা করেছি প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন কিনা? একই জবাব। শুনেছি তিনি পদত্যাগ করেছেন। মনে হয় সে সময় পাননি জানানোর।’
তার মানে ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি যখন ভাষণ দেন, তখনও তিনি শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি বলেছেন মূলত অন্যদের কাছে থেকে শুনে। তার কাছে কোনও পদত্যাগপত্র আসেনি। যদিও তিনি ভাষণে বলেছেন যে, ‘শেখ হাসিনা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন এবং আমি তা গ্রহণ করেছি।’
প্রসঙ্গত, সংবিধানের ৫৭(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হবে যদি তিনি কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র প্রদান করেন। পদত্যাগের সঙ্গে ‘পত্র’ শব্দটি আছে মানে সেটি অবশ্যই লিখিত হতে হবে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি কাছে লিখিত পদত্যাগপত্র না থাকলে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন বলে গণ্য হবে কি না—এই প্রশ্নটি তোলা যেমন সঙ্গত, তেমনি গণঅভ্যুত্থানের মুখে সরকারের পতন হলে তখন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র আছে কি নেই; তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে লিখিত পদত্যাগপত্র দিলেন কি দিলেন না; তিনি সরাসরি বঙ্গভবনে গিয়ে পদত্যাগপত্র দিলেন নাকি ই-মেইল বা অন্য কোনও ইলেকট্রনিক উপায়ে দিয়েছেন; তিনি ফোনে রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন কিনা—এসবের আদৌ কোনও গুরুত্ব আছে কিনা, সেটি আরও বড় প্রশ্ন।
এরকম পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছেন, ‘শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র না পাওয়া নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন মিথ্যাচার করেছেন। রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্য শপথ ভঙ্গ করার শামিল।’ শপথ ভঙ্গ করলে রাষ্ট্রপতির পদে থাকা নীতিগতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। একইদিন জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করে বলেছেন, না হলে বাংলাদেশের মানুষ প্রয়োজনে লংমার্চ টু বঙ্গভবন কর্মসূচি ঘোষণা করবে।
যদিও রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে পাঠানো প্রেস রিলিজে বলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের বিষয়টি মীমাংসিত এবং এ বিষয়ে নতুন করে কোনও বিতর্ক সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে অস্থিতিশীল কিংবা বিব্রত করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।