জনজীবন যেন স্বাভাবিক হয়েও হচ্ছে না। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের উত্তাল স্রোত ভাসিয়ে নিয়ে গেছে ফ্যাসিবাদের তাসের ঘর। তবে জাতি এখন জনতার ত্যাগ ও আবেগে প্লাবিত জমিনে নতুন ব্যবস্থায় গড়ে ওঠার অপেক্ষায়।
জুলাই-আগস্ট রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের প্রাথমিক উচ্ছ্বাস, বিশেষ করে হাসিনা–পতনের সন্তুষ্টি শেষে আমরা এমন এক সময় পার করছি, যার পরবর্তী দৃশ্যে কী আছে, তা তো আমাদের ঠিক জানা নেই–ই; আমাদের বর্তমান নিয়েও কোথায় যেন একটা খটকা রয়ে গেছে।
জনমানসে অনিশ্চয়তা বা চাপা অস্থিরতা আছে। সেই অনিশ্চয়তা বা অস্থিরতা যে বিপ্লবের পলিমাটিতে উৎপন্ন হয়েছে, এমনও নয়।
গত সাড়ে ১৫ বছরে এত ‘উন্নয়ন’ হয়েছে যে সমাজে সম্পদের অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে গোষ্ঠীপ্রীতির সংস্কৃতি সাধারণ মানুষের ‘হক’ অবশিষ্ট রাখেনি।
চার কোটির অধিক মানুষ দারিদ্র্যে ভুগছে—এ তথ্য আমাদের জানতে হচ্ছে জাতিসংঘের প্রতিবেদন থেকে। করোনা মহামারিতে যে নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, তা অগ্রাহ্য করে মধ্য আয়ের দেশের গল্প শুনিয়েছে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সরকার।
বৈষম্যমূলক নীতি অনুসরণ, জনগণের অধিকার হরণ এবং তাদের দুঃখকষ্টকে অস্বীকার করার মূল্য ক্ষমতা ত্যাগ ও দেশ ত্যাগ করে শেখ হাসিনা কিছুটা হয়তো পরিশোধ করেছেন; কিন্তু হাসিনার দীর্ঘমেয়াদি ‘সাফল্য’ হলো জাতীয় অগ্রগতির সম্মিলিত ধারণা এবং ব্যক্তিমানুষের স্বপ্ন ও যোগ্যতাকে অনেকাংশে খর্বকায় করে দেওয়া।
এ কথা সত্য, যেকোনো বিপ্লবের পর নৈরাজ্য, এমনকি প্রতিবিপ্লবের শঙ্কা তৈরি হয়; কিন্তু এ দেশে এবারের অবস্থা আগেকার আন্দোলন ও পরিবর্তনের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।
১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ-পূর্ববর্তী একনায়ক আইয়ুব খান শাসিত ১৯৬০-এর দশক, ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী গণ-অভ্যুত্থানের আগের সময় এবং স্বৈরাচারী শাসক এরশাদের আমলেও জনগোষ্ঠীর মধ্যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের আত্মবিশ্বাস ও নেতৃত্বের শক্তি সঞ্চিত হতে দেখেছি।
কিন্তু বিগত দেড় দশকে হাসিনার ফ্যাসিবাদ সেই আত্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আয়োজন সম্পন্ন করেছে। জাতি যাতে ‘বিদেশি’ সমর্থনপুষ্ট উৎপীড়ককে ‘শ্রদ্ধা’ না করার মজা বুঝতে পারে, সে জন্যই ছিল এ আয়োজন।
ক্যাম্পাস–জীবনে গল্প শুনেছি, এক ‘সর্বগ্রাসী’ মোড়ল তার গ্রামবাসীকে বড়ই যন্ত্রণা দিত। ধূর্ত লোকটি তার আসন্ন মৃত্যু টের পেয়ে গ্রামবাসীর কাছে ক্ষমা চাইল; কিন্তু সংক্ষুব্ধ মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করল।