প্রতিবছর ১১ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস পালিত হয়। এই দিবসকে মেয়েদের দিনও বলা হয়। কিশোরী ও কন্যাসন্তানদের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রত্যেকের রাষ্ট্রীয় ও পারিবারিক পর্যায়ে প্রতিশ্রুতির পুনর্বিবেচনা ও মূল্যায়ন বিচারে দিনটি বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। বিগত দশকে কিছু অগ্রগতি সত্ত্বেও বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মেয়েশিশুরা এখনো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।
জাতিসংঘের বিভিন্ন মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী, ধর্ম, ভৌগোলিক অবস্থান বা বয়সনির্বিশেষে প্রতিটি কন্যাশিশুর নিরাপদ, শিক্ষিত এবং সুস্থ জীবনের অধিকার রয়েছে। এই অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে বিশ্বজুড়ে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় কন্যাশিশুর শারীরিক ও মানসিক গঠন; উন্নয়ন এবং সামাজিক ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষত শিক্ষাক্ষেত্রে এবং জনপরিসরে তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে ২০১৫ সালে ‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলস’ (এমডিজি) এবং পরবর্তী ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস’ (এসডিজি) নির্ধারিত টেকসই উন্নয়নর কর্মসূচি বিবেচনায় কন্যাশিশুদের জন্য কিছু নতুন ও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রচলিত সামাজিক প্রথা ও সনাতন রীতিনীতি এখনো বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি কন্যাসন্তানকে তাদের পূর্ণ বিকাশের সম্ভাবনা অর্জন থেকে বঞ্চিত করছে।
এসডিজি ক্যাম্পেইন চালু হওয়ার পর থেকে বাল্যবিবাহের হার কমলেও অতীতের সেই অর্জন নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাবের কারণে বহু সংকট মিলিয়ে বাল্যবিবাহের প্রকোপ আবারও বাড়ছে, যা অতীতের অগ্রগতিকে বিপরীত দিকে ধাবিত করতে পারে। ইউএনএফপিএর অনুমান অনুযায়ী, মহামারির প্রভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে আরও ১ দশমিক ৩ কোটি কন্যাশিশু বিয়েতে বাধ্য হতে পারে।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে জীবিতদের মধ্যে ৬৪ কোটি মেয়ে ও নারীর শৈশবে বিয়ে হয়েছে এবং প্রতিবছর ১ দশিমক ২ কোটি কিশোরীর বিয়ে হয়েছে। গত পাঁচ বছরে শৈশবে বিয়ে হওয়া ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের হার ২১ থেকে ১৯-এ নেমে এসেছে। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ নির্মূল করার এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে হলে বৈশ্বিক হারে ২০ গুণ দ্রুত হ্রাস ঘটাতে হবে।
মহামারি–পূর্বোত্তর সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বাল্যবিবাহের হার কমে যাওয়ার কারণে বৈশ্বিক হারে কিছু উন্নতি হয়েছে। তবু এ অঞ্চল বিশ্বের প্রায় অর্ধেক (৪৫ শতাংশ) বাল্যবিবাহের শিকার কন্যাশিশুদের আবাসস্থল। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। তবে এখনো এ সমস্যায় জর্জরিত বৈশ্বিক জনগোষ্ঠীর মোটের এক-তৃতীয়াংশের বাস ভারতে।
সে বিবেচনায় বাংলাদেশ আরও একটি জটিল কেস স্টাডি। সমস্যাটি মোকাবিলায় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাল্যবিবাহের সর্বাধিক হার বিচারে বাংলাদেশ এখনো দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে। ইউনিসেফের ২০১৯ সালের একটি জরিপের (বাংলাদেশ মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে–এমআইসিএস) তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে ৫১ শতাংশ তরুণীর বিয়ে হয়েছিল তাঁদের শৈশবে।
কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বাল্যবিবাহের পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০-২৪ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ নারী ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে করেছিলেন। ২০২২ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪০ দশমিক ৯ শতাংশে, যেখানে গ্রামীণ এলাকায় এর হার আরও বেশি, ৪৪ দশমিক ৪।
এ বছরের আন্তর্জাতিক কন্যা দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘ভবিষ্যতের জন্য মেয়েদের ভাবনা’ (গার্লস ভিশন ফর দ্য ফিউচার)। প্রতিবছর বাংলাদেশের জন্য দিনটি আত্মবিশ্লেষণের এবং কন্যাশিশুদের কণ্ঠ ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে চিন্তাভাবনার আরেকটি সুযোগ। তাই আমরা প্রশ্ন করতে চাই, আমাদের দেশে কেন এখনো বাল্যবিবাহের এত উচ্চ হার? নিজেদের ব্যক্তিগত জীবন এবং আত্মনিয়ন্ত্রণে কেন ছেলেদের তুলনায় কন্যাশিশুরা এত পিছিয়ে থাকছে?
১৯৯০ সালে বাংলাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলে উপস্থিতিতে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা পিছিয়ে ছিল। ১৯৯৪ সালে নারী মাধ্যমিক বিদ্যালয় সহায়তা কর্মসূচির (এফএসএসএপি) সূচনা ছেলে-মেয়ের শিক্ষায় অংশগ্রহণ হারের বৈষম্য ব্যাপক পরিবর্তন করেছে। তিন দশক ধরে শিক্ষাক্ষেত্রে নারীবান্ধব সংস্কার সত্ত্বেও বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বিশ্বের বাংলাদেশ অবস্থান অষ্টম।
বিগত তিন দশকে বিভিন্ন উদ্যোগ, যেমন কিশোর-কিশোরী উন্নয়ন ক্লাব, দক্ষতা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং আর্থিক সুবিধা বাস্তবায়িত হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ৪৮৯টি উপজেলা পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত ‘স্বর্ণ-কিশোরী’ ফাউন্ডেশন ক্লাব। সামাজিক অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি এসেছে আইনি সংস্কার।