প্রত্যাবাসন উদ্যোগ জোরদার করতে হবে

গত সাত বছরেও বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য নিরাপদ ও টেকসই পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এ দীর্ঘ সময়ে নানা ধরনের উদ্যোগ ও কার্যক্রম চলমান থাকলেও সমস্যা সমাধানে কোনো আশাব্যঞ্জক উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। ফলে ক্যাম্পে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের মধ্যে হতাশা ক্রমে তীব্র হচ্ছে এবং ক্যাম্পগুলোতে নানা ধরনের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।

মিয়ামারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও রাখাইনে আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ চলমান থাকায় সেখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা এখনো অনিশ্চিত। চলমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘায়িত হওয়ার পাশাপাশি আরও জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। গত সাত বছর ধরে বাংলাদেশ মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গাদের বোঝা টেনে চলেছে। রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সহায়তা কমে আসছে এবং রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশের নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি হচ্ছে। ইউএনএইচসিআরের মতে, বর্তমানে রোহিঙ্গা সমস্যাটি আনুষ্ঠানিকভাবে জরুরি পরিস্থিতি নয় এবং তারা একে এখন প্রলম্বিত পরিস্থিতি মনে করে। এর ফলে মানবিক জরুরি তহবিল এখন বিশ্বজুড়ে চলমান অন্যান্য জরুরি অবস্থা মোকাবিলায় ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে অনেক জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হলেও প্রধান দাতা দেশগুলোর সামগ্রিক সাহায্য বাজেট কমে যাওয়ায় অনেক মানবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে এ সমস্যার সপ্তম বছরে মিয়ানমার ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও দ্রুত সংকট সমাধানের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

চীনের মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের সমন্বয়ে একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ১৭৬ জন রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর ৩২ সদস্যের মিয়ানমার প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসে তালিকাভুক্ত আড়াই শতাধিক রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই-বাছাই করে। এ প্রক্রিয়ায় তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের প্রথমে ট্রানজিট কেন্দ্রে এনে আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ উদ্যোগের প্রস্তুতি হিসাবে ট্রানজিট ক্যাম্প ও রিপ্যাট্রিয়েশন ক্যাম্প নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছিল। ৬ সেপ্টেম্বর স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিলের (এসএসি) চেয়ারম্যান জেনারেল মিং অং হ্লাইং মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলোচনাকালে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের আন্তরিক রাজনৈতিক সদিচ্ছার কথা পুনর্ব্যক্ত করলেও সে দেশে চলমান পরিস্থিতিতে পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করা সম্ভব হয়নি।

২০২৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ১৮তম এশিয়া কো-অপারেশন ডায়ালগ (এসিডি) পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশ চলমান রোহিঙ্গা সংকট ও মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানায়। ১৫ নভেম্বর মিয়ানমারে রোহিঙ্গাসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানবাধিকার নিয়ে একটি প্রস্তাব জাতিসংঘে গৃহীত হয়। এ প্রস্তাবে ১১৪টি দেশ সমর্থন দিয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের আগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে থেকে পর্যাপ্ত অর্থায়নের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ এবং আসিয়ানসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার আহ্বান জানানো হয়।

বাংলাদেশের উদ্যোগে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সব সদস্যরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ‘রোহিঙ্গা মুসলিম ও মিয়ানমারের অন্যান্য সংখ্যালঘুর মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবটি ১০ জুলাই জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের ৫৬তম অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। প্রস্তাবটিতে মিয়ানমারে যুদ্ধরত সব পক্ষকে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেওয়া এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়। মিয়ানমারে সংঘাতের কারণে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশের জানমালের ক্ষয়ক্ষতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রস্তাবটিতে মিয়ানমারকে তার আন্তর্জাতিক সীমান্তে স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। এ প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের জন্য অপর্যাপ্ত ও কমে আসা আর্থিক সহযোগিতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গাদের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা প্রদান করার আহ্বান জানানো হয়।

সহায়তা তহবিল কমে আসায় রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে সংহতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর চাপ পড়ছে। খাদ্যসহায়তা কমে গেলে রোহিঙ্গারা আরও মরিয়া হয়ে উঠবে, যা ক্যাম্পগুলোতে সহিংসতা ও অস্থিরতা বাড়াবে বলে মনে করে জাতিসংঘ।

রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানোর অভিযোগে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে চলমান মামলায় কানাডা ও ব্রিটেনসহ ছয়টি প্রভাবশালী দেশ যুক্ত হয়েছে। এছাড়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের সব জাতিগোষ্ঠীর মানবাধিকার রক্ষায় সর্বসম্মতিতে একটি প্রস্তাব পাশ হয়েছে। বাংলাদেশ আইসিজেতে গাম্বিয়ার করা মামলায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের সমর্থন চেয়েছে। ফ্রান্স, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক ও মালদ্বীপ মামলার প্রতি সম্মতি দিয়েছে। জি-সেভেন দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ১৯ এপ্রিল ইতালির ক্যাপ্রিতে অনুষ্ঠিত বৈঠকে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরির প্রয়োজনীয়তা এবং রোহিঙ্গা ও অন্যান্য জাতিগত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিতের ওপর জোর দিয়েছে। এসব উদ্যোগের কারণে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে বলে অনেকে মনে করছে।

মিয়ানমারে চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হচ্ছে না। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সংঘাতের তীব্রতা বেড়েই চলছে। রাখাইন রাজ্যে বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে এএ’র সংঘর্ষের কারণে গত ফেব্রুয়ারি থেকে বিজিপি ও অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা বান্দরবান ও কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া শুরু করে। ১৫, ২৫ এপ্রিল ও ৯ জুন তিন দফায় ৭৫২ জন বিজিপি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১২৩ জন বিজিপি সদস্য পুলিশ হেফাজতে রয়েছে। চলমান রাজনৈতিক সংকটের কারণে তাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা বিলম্বিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চল বর্তমানে এএ’র নিয়ন্ত্রণে। এএ রাখাইনের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। রোহিঙ্গাদের রাখাইন প্রদেশে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে যে কোনো পরিস্থিতিতে মিয়ানমার সরকারের পাশাপাশি এএ’কে বিবেচনায় রাখতে হবে। বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে নতুন করে উদ্যোগ নিতে হবে। রাখাইন রাজ্যে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে মিয়ানমারের সংঘাত বন্ধের জন্য আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সব পক্ষের চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। রাখাইনের স্থিতিশীল পরিস্থিতি নিশ্চিতপূর্বক চীনের উদ্যোগে নেওয়া চলমান পাইলট প্রকল্পকে সফল করে সামনের দিনগুলোতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চলমান রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যদিকে যে কোনো পরিস্থিতিতে ত্রাণ ও আর্থিক সাহায্য চলমান রাখতে জরুরি ভিত্তিতে আপৎকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ ও রিজার্ভ গড়ে তোলার ব্যবস্থা নিতে হবে।