বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থান রূপ নেওয়ার পর শিক্ষার্থীদের ৯ দফা যখন ১ দফায় চলে আসে, তখনই বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রবল পরাক্রমশালী শাসক শেখ হাসিনার বিদায়ঘণ্টা বেজে ওঠে। ৫ আগস্ট সকালে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ঢাকায় জড়ো হতে থাকলে, শেখ হাসিনা তাৎক্ষণিক দেশ ছেড়ে চলে যান। এত দিন যাদের ওপর ভর করে তিনি ক্ষমতায় টিকে ছিলেন, সেই পুলিশ ও নিজ দলের আর্মড ক্যাডারের সদস্যরাও জনরোষ থেকে তাঁকে রক্ষা করতে পারেনি।
শেষ ভরসা, সশস্ত্র বাহিনীও তাঁর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনি ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন। ওই মুহূর্তে ভারতে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া তাঁর অবশ্য আর কোনো গত্যন্তরও ছিল না। নিজ দেশের তিন শতাধিক নাগরিকের খুনের রক্তে যাঁর হাত রাঙা, তেমন একজন পতিত শাসককে আশ্রয় দেওয়া, প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের জন্যও অস্বস্তিকর ছিল। তবু ভারত তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে নেয়।
জানা গেছে, খুব অল্প সময়ের নোটিশে ভারত শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিতে সম্মত হয়েছে। ৬ আগস্ট ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় এ বিষয়ে সবাইকে অবগত করেন। তিনি জানান, যত দিন তৃতীয় কোনো রাষ্ট্রে শেখ হাসিনার আশ্রয়ের ব্যবস্থা না হবে, তত দিন তিনি ভারতেই থাকবেন।
শেখ হাসিনা কয়েকটি বিদেশি রাষ্ট্রে আশ্রয়ের চেষ্টা করলেও কোনো দেশই তাঁকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি। তবে শেখ হাসিনার ভারত ছেড়ে যাওয়া নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। অনেকেরই প্রশ্ন, শেখ হাসিনা সত্যিই কি ভারত ছেড়ে অন্যত্র যেতে ইচ্ছুক? নাকি তিনি ভারতেই থেকে যেতে চান? ভারতে থাকতে পারলে শেখ হাসিনার সুবিধাই হবে। ভারতে বসে বাংলাদেশে দলীয় রাজনীতি পরিচালনা করতে পারবেন। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ও তাই মনে করেন। ১৪ আগস্ট ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জয় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় তা দেখার জন্য তিনি (শেখ হাসিনা) অপেক্ষা করছেন।
সম্ভবত মা আপাতত ভারতেই থাকবেন।’ শেখ হাসিনা বর্তমানে দিল্লির সন্নিকটে ভারতীয় বিমানঘাঁটিতে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবেষ্টনীতে অবস্থান করছেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মতে, নিরাপত্তাজনিত কারণে শেখ হাসিনার সঙ্গে কাউকে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি দিল্লিতে অবস্থানরত শেখ হাসিনার কন্যা পুতুলও নাকি তাঁর মায়ের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাননি। সত্যিই কি তাই?
হাসিনাকে যদি কড়া নিরাপত্তাবেষ্টনীতেই রাখা হতো, তাহলে ভারতীয় বিমানঘাঁটির মতো একটি সংবেদনশীল জায়গায় বসে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী মামলায় অভিযুক্ত শেখ হাসিনা তাঁর নেতা-কর্মীদের, বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হতে পারে—এমন রাজনৈতিক নির্দেশনা দেন কী করে? এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান পরিষ্কার।
১৪ আগস্ট বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনারকে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, ভারত ভূখণ্ডে বসে শেখ হাসিনা যেসব বিবৃতি দিচ্ছেন, তা দুই নিকট প্রতিবেশী দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অন্তরায়। এটা দুই দেশের সুসম্পর্কের জন্য সহায়কও নয়।
ভারতের বাংলাদেশনীতি নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ কখনোই সন্তুষ্ট ছিল না। স্বাধীনতার পর থেকেই দেখা গেছে, ভারত বরাবরই বাংলাদেশের জনগণের মনোভাবকে অবজ্ঞা করে এককভাবে একটি দলের প্রতিই বেশি আগ্রহ দেখিয়ে এসেছে। তারা জনগণের চেয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এ নিয়ে ভারত বিষয়ে এ দেশের জনগণের ভেতর মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ কোনোকালেই আধিপত্যবাদকে মেনে নেয়নি। আর মেনে নিতে পারেনি বলেই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আলাদা হয়ে গেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের অবদান অনস্বীকার্য। এ কথা এ দেশের মানুষ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকারও করে। কিন্তু ভারত একেবারে নিঃস্বার্থভাবে স্বাধীনতা অর্জনে বাংলাদেশকে যে সহায়তা করেছে, সে কথা সঠিক নয়।