বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর যে সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করেছিল, সেটা হলো আইনশৃঙ্খলার সমস্যা। কোনো দেশে যদি আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে এবং নৈরাজ্য দেখা দেয়, তখন সেদেশের পক্ষে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান দায়িত্ব হলো নাগরিকদের জানমাল ও স্বাধীনতা রক্ষা করা। ১৫ বছরের অধিক কাল ধরে এদেশে চলেছে শেখ হাসিনার এক নায়কত্ববাদী স্বৈরশাসন। এ শাসনব্যবস্থা এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, এর চেয়ে কেন্দ্রীভূত আর কোনো শাসনব্যবস্থার দৃষ্টান্ত দেওয়া সম্ভব নয়। সবকিছু চলত এবং ঘটত ওই এক লৌহমানবীর অঙ্গুলিহেলনে। তার ওপর কথা বলার অধিকার কারোরই ছিল না। তিনি নিজের খেয়াল-খুশি ও মর্জিমতো দেশ চালাতেন।
আমি এক বয়োবৃদ্ধ বুদ্ধিজীবীর কথা জানি, যিনি তার বক্তৃতা-বিবৃতিতে, লেখাজোখায় সবসময় নৈতিকতা, নীতিবোধ, শততা ও শ্রেয়বোধের কথা বলেন। ছাত্রজীবন থেকে তাকে এসব কথা বারংবার আওড়াতে শুনেছি। কিন্তু ব্যক্তিজীবনের এবং ব্যক্তিস্বার্থের কিছু প্রশ্নে তার মতো সুবিধাবাদী ও নৈতিকতাহীন মানুষ আর দেখিনি। তার সম্পর্কে আমার এই ধারণা এত প্রবল হতো না, যদি না তিনি নৈতিকতা ও শ্রেয়বোধের কথা বলতেন। স্বজনপ্রীতিতে তাকে হার মানাতে পারে এমন লোকের দেখা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাকে এক টিভি টকশোতে বলতে শুনেছি, শেখ হাসিনা নেতৃত্বগুণে তার পিতাকে অনেক দূর অতিক্রম করে গেছেন। অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানের তুলনায় শেখ হাসিনার নেতৃত্ব অনেক উঁচু মানের। শেখ হাসিনার পদস্খলনের মূলে একদিকে যেমন রয়েছে দারুণ আত্মম্ভরিতা, অন্যদিকে রয়েছে এ ধরনের বুদ্ধিজীবীদের তোয়াজ-তোষামোদ। এ করণেই তিনি মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। হয়ে উঠছিলেন দুর্বিনীত ও লাগামহীন। ছোটবেলায় বাল্যশিক্ষায় পড়েছিলাম অহংকার পতনের মূল। এ শিক্ষা তো ভুল হওয়ার কথা নয়। আজ শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনে যে কুজ্ঝটিকার সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে রয়েছে অহংকার এবং ‘কুচ্ পরোয়া নেহি’ মনোভাব।
শেখ হাসিনা যখন পদত্যাগ করে দেশ ছাড়লেন, তখন দেশকে তিনি রেখে গেলেন এক মহাবিপর্যয়ের মধ্যে। শত শত শহিদের রক্তস্রোত ও মায়ের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। এমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড আমি আমার ৭৯ বছর বয়সে আর কখনো দেখিনি। হ্যাঁ, একটা সময় ছিল ব্যতিক্রম, সেটা ছিল ’৭১-এ পাকবাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ড। কিন্তু তার প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। উপনিবেশবাদীরা যদি হত্যাকাণ্ড চালায়, তাহলে সেটা উপনিবেশবাদের চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশে কেন শাসকগোষ্ঠী বেপরোয়া হত্যাকাণ্ড চালাবে? মানুষ মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে উঠেছিল। এক পুলিশ তার কর্মকর্তাকে জানিয়েছিল, একজনকে মারি তো অন্যরা সরে যায় না। বুক চিতিয়ে এগিয়ে আসে। এভাবে মৃত্যুভয়কে যারা জয় করেছে, তাদের কি আর পরাজিত করা সম্ভব?
শেখ হাসিনার শাসনব্যবস্থা ছিল পুলিশি শক্তিনির্ভর। অনেকে দেশটাকে বলত পুলিশি রাষ্ট্র! শেখ হাসিনার পুলিশ কত রকমের অপকর্ম করেছে! পুলিশ লাখো মানুষের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে, মামলার অভিযোগপত্রে অজানা শত শত মানুষের কথা বলেছে, যাতে যে কোনো অসিলায় যে কোনো মানুষকে মামলায় অভিযুক্ত দেখিয়ে গ্রেফতার করতে পারে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্তকে আদালতে হাজির করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হয়নি, রিমান্ডে নিয়ে তারা তাদের দৃষ্টিতে অভিযুক্তদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। পুলিশি মামলায় শত-সহস্র পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। অনেকে গ্রেফতার এড়ানোর জন্য রাজধানীতে এসে রিকশাচালক হয়েছে অথবা হয়েছে চৌরাস্তার ফুল বিক্রেতা। শেখ হাসিনার শাসনামলে নির্যাতন পুলিশবাহিনীর দ্বারা সীমিত ছিল না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল র্যাবের বিভীষিকাময় অত্যাচার ও নির্যাতন। গুম, খুন ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। আয়নাঘরকেন্দ্রিক সীমাহীন যাতনাময় দিনযাপন অনেক বন্দির জীবনে অন্ধকার কুঠুরির বিভীষিকা নিয়ে এসেছিল। এ বন্দিদের আপনজনরা জানত না তারা কোথায় আছেন। অন্ধকার গহ্বরে সংকীর্ণ সেলের মধ্যে তারা দিবারাত্রির পার্থক্য বুঝতে পারতেন না। তাদের দেওয়া হতো পচা-গলা বাসি খাবার। এ খাবার গলাধঃকরণ করা ছিল অসহনীয় এক অত্যাচার! বছরখানেক আগে কাতারভিত্তিক আলজাজিরা টেলিভিশন আয়নাঘরের ভয়াবহতা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরে। সেই থেকে আয়নাঘরের রহস্য নিয়ে এদেশের জনগণের কৌতূহল বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত ছাত্র-তরুণদের আগস্ট অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আয়নাঘরের রহস্য উন্মোচিত হয়ে গেছে। এখন প্রয়োজন ক্ষমাহীনভাবে আয়নাঘরের কুশীলবদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা। অন্যথায় মানবতার চরম পরাজয় ঘটবে।