কথায় আছে, ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়’। যদিও ইংরেজিতে বলা হয়, ‘টাইম অ্যান্ড টাইড ওয়েট ফর নান’; যার অর্থ হলো, সময় ও নদীর স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না; অর্থাৎ সময়ের কাজ সময়ে না করলে পরে অনেক চেষ্টা করেও সফল হওয়া যায় না।
কথাগুলো কারোরই অজানা না হলেও সচরাচর আমরা তা মনে রাখি না। মনে যে রাখি না তার নজির অসংখ্য। সবশেষ নজিরটি রাখলেন সম্প্রতি ক্ষমতা ছেড়ে, নিজ দলের অসংখ্য কর্মী-সমর্থককে অরক্ষিত রেখে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালেই জাতীয় সরকারের ধারণাটি প্রথম সামনে এসেছিল। তখন আওয়ামী লীগের বাইরে যেসব রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তাদের প্রস্তাব ছিল—সব দলকে নিয়ে সরকার গঠন করা হোক। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সেই প্রস্তাবে সায় না দিয়ে এককভাবে সরকার গড়েছিল। যদিও একপর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তার জন্য মুজিবনগরে আওয়ামী লীগসহ পাঁচটি দলের আটজন সদস্য নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছিল।
স্বাধীনতার পরও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সব দলকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করার দাবি তুলেছিলেন তখনকার ন্যাপ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ। তখনো দাবিটি আমলে নেয়নি আওয়ামী লীগ। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিআইএ) এক গোপন দলিলে (১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১) উল্লেখ আছে, ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও চাইছিলেন যে স্বাধীন বাংলাদেশে একটি জাতীয় সরকার হোক।
কিন্তু তখন আওয়ামী লীগের নেতাদের মনোভাব এমন ছিল যে তাঁরাই দেশটা স্বাধীন করেছেন, শুধু তাঁরাই শাসন করবেন। কিছুদিনের মধ্যেই দেশের পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলে জাতীয় সংসদে ২৯৩টি আসন নিয়েও সামাল দিতে পারছিল না বঙ্গবন্ধুর সরকার। সে অবস্থায় স্বাধীনতার তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করেছিলেন। তখন সমমনা কয়েকটি দলকে একীভূত করে কার্যত একদলীয় সরকারকেই জাতীয় বলে চালানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। অসময়ের সে চেষ্টার ফল কী হয়েছিল, সে কথা সবারই জানা।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলাকালে সরকার সরাসরি আলোচনার উদ্যোগ নিলে সেটি সহিংসতার দিকে গড়াত না। কিন্তু সরকার সময়মতো তেমন উদ্যোগ তো নেয়ইনি, উল্টো ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু তাতে ফল হলো উল্টো। গত ১৫ জুলাই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের প্রতিরোধের মুখে ছয় ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয়। সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনের ‘সুরক্ষিত দুর্গ’ পতনের একই রকম চিত্র দেখা গেছে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে ক্ষমতাসীনদের দর্প চূর্ণ হয়ে যায় আলপিনের সামান্য খোঁচায় চুপসে যাওয়া ফাঁকা বেলুনের মতো। এরপরও সরকার অনেক হেলাফেলা ও সময়ক্ষেপণ করেছে, এমনকি নানা রকম কূটচাল চালারও চেষ্টা করেছে। শেষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকলে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী খোলামেলা আলোচনার আহ্বান জানান। কিন্তু ততক্ষণে জল অনেক দূর গড়িয়ে যায়। বদলে যায় আন্দোলনকারীদের দাবিও।