বাংলাদেশের উত্তর জনপদের লালমনিরহাট জেলার শেষ সীমানায় অবস্থিত বুড়িমারী একটি স্থলবন্দর। ৫টি উপজেলা নিয়ে লালমনিরহাট জেলা গঠিত। এ জেলা থেকে বুড়িমারী স্থলবন্দর পর্যন্ত এ রুটকে বলা হয় বিডিআর (বেঙ্গল ডুয়ার্স রেলওয়ে) লাইন। বুড়িমারী থেকে লালমনিরহাট জেলার দূরত্ব ৯০ কিলোমিটার। এ রুটে ট্রেন কখন আসে আর কখন যায় তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান। ব্রিটিশ আমলে এর জন্ম হলেও স্বাধীনতার ৫৩ বছরে বাংলাদেশ বিভিন্ন দিক থেকে এগিয়ে গেলেও রেলওয়ের অবস্থার তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নতি হয়নি। পত্রিকান্তরে জানা যায়, এক টাকা আয় করতে রেলের ব্যয় হয় ৬ টাকা। আরও জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে রেল থেকে আয় হয়েছে ১ হাজার ১৩ কোটি টাকা, কিন্তু এ সময় ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ২৫ কোটি টাকা। ২০২২ সালে রেলে ৩৯টি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এজন্য ব্যয় ধরা হয় ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা। প্রতিবছর জনগণের করের বিপুল অঙ্কের অর্থ লোকসান হয়। এভাবে লোকসান দিয়ে রেল কতদিন চলবে? বিশেষজ্ঞদের মতে দক্ষতা বাড়িয়ে, যাত্রীসেবার মান বাড়িয়ে অনায়াসে রেলের লোকসান কমানো সম্ভব। অথচ দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে রেলের গুরুত্ব অপরিসীম হলেও জনগুরুত্বপূর্ণ এ খাতটির দিকে সংশ্লিষ্ট মহলের তেমন কোনো উদ্যোগ কখনোই পরিলক্ষিত হয়নি।
বুড়িমারী স্থলবন্দর হওয়ার কারণে এ রুটের গুরুত্ব অনেকাংশে বেড়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু বাস্তবে দীর্ঘদিন ধরে এটি অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে বলা যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ইত্যাদিসহ অন্যান্য দিক থেকে বাংলাদেশের সব থেকে পিছিয়ে পড়া অনুন্নত এলাকা সম্ভবত এটাই। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি সরকারের আমলেই বৈষম্যের শিকার এ এলাকার মানুষ। অনুন্নত এবং পিছিয়ে পড়ার কারণে এ এলাকার অধিকাংশ মানুষই আর্থিক দিক থেকে সাশ্রয়ী, নিশ্চিত ও নিরাপদ ভ্রমণ, যানজটের কবল থেকে রক্ষা ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে রেলে ভ্রমণ করতেই স্বচ্ছন্দবোধ করে। এ রুটে ভ্রমণের জন্য বাস সার্ভিস চালু থাকলেও দূরদূরান্ত থেকে লাগেজ বা মালামাল নিয়ে বাস ভ্রমণের ঝক্কিঝামেলাও অনেক এবং তুলনামূলকভাবে রেলের চেয়ে বাসের ভাড়া কয়েকগুণ বেশি। তাই এখানকার অধিকাংশ মানুষই বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণি এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণিটা রেলের ওপর নির্ভরশীল। এখানে উল্লেখ্য, পিছিয়ে পড়া এ অঞ্চলের মানুষের সুবিধার জন্য বুড়িমারী থেকে রাজধানী ঢাকা যাতায়তের জন্য ‘বুড়িমারী এক্সপ্রেস’ নামে একটি ট্রেন চালু করা হলেও ট্রেনটি বুড়িমারী থেকে না ছেড়ে লালমনিরহাট রেলওয়ে জংশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। বুড়িমারী স্থলবন্দর হওয়ার সুবাদে এ অঞ্চলের মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল এই ভেবে যে, বুড়িমারী থেকে সরাসরি ঢাকায় যেতে আর কোনো ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হবে না। কিন্তু বুড়িমারী এক্সপ্রেস ট্রেনটি বুড়িমারী থেকে না ছাড়ায় এ অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন অন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছিল।
প্রসঙ্গত, ১১ অক্টোবর ২০১১ সালে বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার এক জনসভায় বুড়িমারী-ঢাকা রুটে একটি আন্তঃনগর ট্রেন ‘তিনবিঘা এক্সপ্রেস’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রায় এক বছর পর ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর লালমনিরহাট সদরে এক জনসভায় আবারও তিনি এ প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন। কিন্তু এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবে রূপ নেয়নি। দুর্ভাগ্যজনক হলো, এত দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও এবং এত আন্দোলন-সংগ্রাম করার পরও এ অঞ্চলের মানুষের দাবি-দাওয়া পূরণ না হওয়ায় গত ১৭.১২.২৪ তারিখে তারা সড়কপথ ও রেলপথ অবরোধ করে। শুধু তাই নয়, তাদের দাবি-দাওয়ার প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে এ এলাকার ব্যবসায়ীরাও তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখে। সর্বস্তরের মানুষ এ আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিয়ে অংশগ্রহণ করে। ইতঃপূর্বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করলেও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া না যাওয়ায় তারা আলটিমেটাম দেন যে, ট্রেনটি বুড়িমারী থেকে ছেড়ে না গেলে জনসাধারণ আমরণ অনশনে যাবেন। কিন্তু তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার প্রতি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কোনো সম্মান বা গুরুত্ব এখনো পর্যন্ত প্রদর্শন করেনি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে গঠিত সরকার যদি বৈষম্যের শিকার এ অঞ্চলের মানুষের ন্যায়সংগত দাবি-দাওয়া পূরণে এগিয়ে না আসে, তাহলে দেশের সর্বক্ষেত্রে বিরাজিত বৈষম্য নিরসনের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করে বহু ছাত্র, জনতা বুকের তাজা রক্ত ঝরানোয় কী লাভ হলো? এরকম বৈষম্যপূর্ণ স্বাধীন বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম? পাকিস্তান আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বরাবরই বৈষম্যের শিকার হয়েছে এ উত্তর জনপদের মানুষ। বিশেষ করে বিডিআর লাইনের মানুষ। অথচ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে প্রথম বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে এ জনপদের ছাত্র শহিদ আবু সাঈদ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ গঠন হলো অথচ রংপুর বিভাগ থেকে কোনো উপদেষ্টা সেখানে স্থান পেল না! এটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। উত্তরাঞ্চলের মানুষ কি সারাটা জীবন শুধু বৈষম্যের শিকার হয়েই থাকবেন? এ বৈষম্যের কোনো অবসান হবে না? রংপুরের জনগণ যখন উপদেষ্টার দাবিতে মাঠে নেমেছিল, তখন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, আমি রংপুরের উপদেষ্টা। যতদূর মনে পড়ে আবু সাঈদের বাড়িতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন রংপুরের উন্নয়নের জন্য যথাসম্ভব সবকিছুই তিনি করবেন। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের চার মাস পার হলেও রংপুরের উন্নয়নের জন্য তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। শুধু তাই নয়, আজ রংপুর বিভাগের লালমনিরহাট জেলার চারটি উপজেলার ভুক্তভোগী মানুষ যখন ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য পথে নেমেছে, আন্দোলন করছে, তখনো এ সরকার তাদের দাবির প্রতি সম্মান না জানিয়ে নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে। এ অবস্থার দ্রুত অবসান হওয়া উচিত।
বুড়িমারী স্থলবন্দর থেকে উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরসহ অনেক স্থানে সরাসরি যাওয়ার কোনো ট্রেন নেই। লালমনিরহাটে গিয়ে যাত্রাবিরতি করতে হয়। এ লাইনের বাউরা স্টেশনটি ৬/৭ বছরের বেশি বন্ধ ছিল। এ স্টেশনের স্টেশন মাস্টার অবসর গ্রহণের পর সেখানে দীর্ঘদিন পর্যন্ত নতুন মাস্টার নিয়োগ বা পোস্টিং দেওয়া হয়নি। ভোটমারী, আদিতমারী স্টেশনও স্টেশন মাস্টারের অভাবে দীর্ঘসময় বন্ধ ছিল। হাতিবান্ধা ও ভোটমারীসহ অনেক স্টেশনে সুইপার না থাকায় নোংরা দুর্গন্ধে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকাই কঠিন। ওয়েটিং রুমগুলোর অবস্থা তথৈবচ। হাতিবান্ধা ও আদিতমারী উপজেলা হেডকোয়ার্টার হওয়ার পরও এ স্টেশনগুলোর অবস্থাও একই রকম। এ এলাকার অধিকাংশ যাত্রী টিকিট ছাড়াই অনায়াসে রেল ভ্রমণ করে। অনেকে টিকিট কেটে ভ্রমণ করতে চাইলেও অনেক সময় কাউন্টার বন্ধ থাকায় টিকিট ছাড়াই ভ্রমণ করতে বাধ্য হয়। পত্রিকান্তরে জানা যায়, বর্তমানে ৪৯৩টি স্টেশন এবং ৩৬৭টি যাত্রীবাহী ট্রেন সচল রয়েছে।