নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সরকারের উপদেষ্টাদের তালিকা দেখে মনে হয় এটি একটি ‘টেকনোক্রেট’ সরকার, যেখানে রয়েছেন বিশেষজ্ঞরা এবং সুশীল সমাজের লোকরা। আন্দোলনকারীরা চাইছেন ‘রাষ্ট্রের সংস্কার’, শুধু ক্ষমতা পরিবর্তন নয়। ‘বৈষম্যবিরোধী’ অবস্থান, ‘রাষ্ট্রের সংস্কার’-এসব অনেক বড় এজেন্ডা, গভীর এজেন্ডা। মনে হচ্ছে ছাত্ররা তা-ই চান। কিন্তু বিষয়টি বহুমুখী ও সময়সাপেক্ষ-দীর্ঘমেয়াদি বিষয়, কোনো সাধারণ বিষয় নয়। এ কারণে বলা যায়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এটা হবে একটা কঠিন কাজ। প্রথমত, তারা অনির্বাচিত। দ্বিতীয়ত, তাদের মেয়াদ কতদিনের, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বিষয়টি গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে সবাইকে। ইতোমধ্যে ময়লা জমেছে সর্বত্র। কার্পেট তুললেই দুর্গন্ধ। এ দুর্গন্ধময় অবস্থাটা সমাজ বুঝতে পারছে। অবশ্য এ মুহূর্তে যে সমস্যা মানুষকে পীড়া দিচ্ছে, হাঁপিয়ে তুলেছে, তা হলো মূল্যস্ফীতি, যা গত প্রায় দুবছর ধরে ১০ শতাংশের উপরে সরকারিভাবেই। দীর্ঘমেয়াদি কাজ অনেক, সেসব দেখতে হবে অবশ্যই। আর সেসব সমস্যা চিহ্নিত, বহুল আলোচিত।
বস্তুত এসব সমস্যার সমাধান মানুষ সবসময়ই চেয়েছে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমরা চেয়েছি। যা চেয়েছি, তার ঠিক উলটোটি ঘটেছে। ক্ষমতার রদবদল, দলবদল বহু হয়েছে, দেশ বিভক্ত হয়েছে এসব ইস্যুতে। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত প্রতিফলন কখনো ঘটেনি। এর অর্থ এই নয় যে, ইতোমধ্যে দেশের কোনো অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়নি। অবশ্যই হয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে জন্ম নিয়েছে অনেক প্রশ্ন, যা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, একটি কাগজের খবরের শিরোনাম হচ্ছে ‘১৫ বছরে আওয়ামী সরকার ঋণ করেছে সাড়ে ১৫ লাখ কোটি টাকার বেশি : এ সময়ে দেশ থেকে পাচার হয়েছে ১৫০ বিলিয়ন ডলার’ (এক বিলিয়ন সমান শত কোটি)। উল্লেখিত কাগজটির হিসাবে ২০০৯-২০২৩ সালের মধ্যে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়েছে ১৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। তার মানে কী? যা ঋণ করেছে সরকার, তার চেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে অন্তর্বর্তী ও নির্বাচিত সরকারের সামনে দাঁড়াবে দুটি বড় সমস্যা : দেশি/বিদেশি সরকারি ঋণ এবং অর্থ পাচার। এ ছাড়াও রয়েছে অনেক সমস্যা, দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও। সে আলোচনা আজ নয়।
মোটা দাগে এ মুহূর্তে অন্তর্বর্র্তীকালীন সরকারের কাজ হওয়া দরকার একটা ‘পজিশন পেপার’ তৈরি করা। আর্থিক খাতের প্রকৃত পরিস্থিতি কী তা আমাদের বোঝা দরকার, কারণ সাম্প্রতিককালে আমরা তথ্য সন্ত্রাসের শিকার হয়েছি। কোনো তথ্যেরই ‘মা-বাবা’ নেই। বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে আমরা গন্ডগোল করেছি। এটা ইচ্ছাকৃত ছিল কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা দরকার। আমাদের রপ্তানির হিসাব ঠিক নেই। ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। সর্বশেষ দেখলাম আমাদের রাজস্ব আয়ের হিসাবও ঠিক নেই। যা আদায় হয়েছে বলছি, তার থেকে ৯৪ হাজার কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে শুধু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে। গোল আলুর হিসাব ঠিক নেই। চালের হিসাব ঠিক নেই। বাকিগুলোর কথা নাইবা বললাম। এ কারণেই আমি মনে করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটা বড় কাজ হবে ‘ইকোনমিক পজিশন পেপার’ তৈরি করা, যাতে পরবর্তী সময়ে নির্বাচিত সরকার এর ওপর ভিত্তি করে কাজ করার সুযোগ পায়। এছাড়া তাদের সাধারণভাবে ‘রুটিন জব’ করার কথা, যদি না তারা মৌলিক বিষয়ে হাত দেয়। মৌলিক বিষয়গুলো বেশ কিছুটা রাজনৈতিক। অরাজনৈতিক টেকনোক্রেট সরকার সেসবে হাত দেবে কিনা আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত নই। কিন্তু এ মুহূর্তে কিছু কাজ ‘ফরজ’ মনে হচ্ছে এবং তা খবরের কাগজ দেখলেই বোঝা যাবে।
মূল্যস্ফীতি রোধের কাজ এক নম্বরে, যা আগেই বলেছি। এরই মধ্যে একটি কাগজের গত ৭ আগস্ট সংখ্যায় বেশকিছু অর্থনৈতিক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। সেসব খবরের শিরোনামগুলো হচ্ছে : ‘৬৭ শিল্পকারখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ’, ‘আমদানি-রপ্তানি কার্যত বন্ধ’, ‘লুটপাটের আশঙ্কায় দীর্ঘসময় দোকান বন্ধ ছিল’, ‘ইসলামী ব্যাংকে অস্থিরতা’ এবং ‘গভর্নর অফিস করেননি, বাধা নেই সাংবাদিক প্রবেশে’। যদি শেষের খবরটি প্রথমে ধরি, তাহলে বলতে হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যত এখন বন্ধ। বুধবার দুপুরে ডেপুটি গভর্নরদের ব্যাংক থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। এসব করেছেন উচ্ছৃঙ্খল কর্মকর্তারা। তারা ডেপুটি গভর্নরদের কাছ থেকে পদত্যাগপত্র সই করে রেখেছেন বলে খবর। ইসলামী ব্যাংকে তীব্র অসন্তোষ চলছে। সেখানে বহু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অফিসে ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। কোথাও ‘এটিএম’ বুথ ভাঙা হয়েছে। এসব খবর সত্য হলে তা খুবই উদ্বেগজনক। তবে এটা বোঝা যায়, এ খাতে তীব্র অসন্তোষ রয়েছে। বর্তমান গভর্নর ব্যাংক খাতে পদোন্নতি বন্ধ রেখেছেন। স্বৈরাচারী আচরণ করে তিনি ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশ বন্ধ করেছিলেন। বহু ব্যাংক থেকে বহু কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে বিদায় করা হয়েছে। এ অসন্তোষ দূর করা দরকার অনতিবিলম্বে, যাতে ব্যাংকাররা শান্তিতে কাজ করতে পারেন।
পরে অবশ্য এ খাতে অনেক বড় বড় কাজ আছে। খেলাপি ঋণে জর্জরিত ব্যাংক খাত। লুটেরারা রয়েছে ব্যাংকের মালিকানায়। আমদানির মাধ্যমে দেশ থেকে লুটের, অর্থ পাচারের অস্ত্র হয়ে উঠেছে ব্যাংকগুলো। সর্বত্র বিশৃঙ্খলা। ব্যাংকিং নিয়মকানুন লঙ্ঘিত হয়েছে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ঘটেছে পদে পদে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিচ্ছে। অথচ তার মূল যে দায়িত্ব-মূল্যস্ফীতি রোধ-এক্ষেত্রে কোনো সফলতা নেই। এ খাতকে ‘সিধা’ করতে না পারলে অনেক কাজই করা যাবে না।