বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীন হয়েছে। দেশের নাগরিকদের ধারণা শেখ হাসিনার ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী একনায়কত্বে তারা অধিকারহারা হয়ে পড়েছিল। শুধু গণতান্ত্রিক অধিকারবর্জিত হয়ে নয়, আরও অনেক কারণে তারা পরাধীন হয়ে পড়েছিল। অর্থাৎ একদিকে নাগরিক স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলা এবং অন্যদিকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের গর্বিত নাগরিক হওয়ার আনন্দবঞ্চিত হওয়া, এই দুটোই ঘটেছিল বাংলাদেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে। দুবার স্বাধীন হওয়ার প্রপঞ্চটি শুধু সাধারণ মানুষের নয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো নোবেলজয়ী ব্যক্তিত্বও একই কথা বলেছেন। দুবার স্বাধীনতার ধারণাটি মেনে নিলে মানতে হবে আমরা স্বাধীনতা হারিয়ে বসেছিলাম। এ স্বাধীনতা কীভাবে হারিয়ে গেল, তা বুঝতে হলে ইতিহাসটি পর্যালোচনা করতে হয়। এ পর্যালোচনা কোনো ছোটখাটো আলোচনা হতে পারে না। এ নিয়ে রীতিমতো একটি পিএইচডি থিসিস লেখা যায়। আলোচ্য প্রবন্ধে সে রকম সু-বিস্তৃত কিছু লেখার সুযোগ নেই।
শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ এবং দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। যে আন্দোলন সূচিত হয়েছিল ছাত্রদের কোটা সংস্কারের মতো একটি নিরীহ দাবি জানিয়ে, সেই আন্দোলন নানা ঘাতপ্রতিঘাতে, কথার পিঠে কথার আঘাতে পরিণত হয় আত্মমর্যাদা জানান দেওয়ার এক মহাবিস্ফোরণে! শত শত শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ পুলিশসহ রংবেরঙের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্মম ও হৃদয়বিদারক গুলিবর্ষণে নিহত হয়। আহত হয় কয়েক সহস্রাধিক। কারাবন্দি করা হয় বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক কর্মী ও নিরীহ সাধারণ মানুষকে। এলাকায় এলাকায় গভীর রাতে বিদ্যুতের বাতি নিভিয়ে দিয়ে ব্লক রেইড করা হয়। তালিকাবদ্ধ ব্যক্তিকে না পাওয়া গেলে তার আত্মীয়-স্বজনকে গ্রেফতার করা হয় এবং ঘরের আসবাবপত্র তছনছ করা হয়। পুলিশি জুলুম চলে মাত্রাতিরিক্তভাবে। পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইতিহাসে যত গণআন্দোলন হয়েছে, এবারের গণঅভ্যুত্থানে নিহতের সংখ্যা কম হলেও দশগুণ। খুনি শেখ হাসিনা মনে করেছিলেন হত্যা করে এই গণবিদ্রোহ দমন করবেন। সে ব্যাপারে তার কোনো রাখঢাক ছিল না। মিয়ানমারের ইয়াংগুন বিশ্ববিদ্যালয়ে সে দেশের সামরিক কর্তৃপক্ষ একদিনে দু-হাজার শিক্ষার্থীকে হত্যা করে ছাত্র-আন্দোলন দমন করেছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল ষাটের দশকে। সেই থেকে মিয়ানমারে সামরিক কর্তৃপক্ষের শাসন অব্যাহত আছে। মাঝে মাঝে শাসনের ধারায় কিছু হেরফের হলেও শাসনব্যবস্থায় সামরিক কর্তৃপক্ষের শাসন অব্যাহত আছে। মাঝে মাঝে শাসনের ধারায় কিছু হেরফের হলেও শাসনব্যবস্থার সামরিক চরিত্রটি বদলায়নি। শেখ হাসিনারও শাসনব্যবস্থার সামরিক চরিত্রটি বদলায়নি। শেখ হাসিনাও ভেবেছিলেন, মিয়ানমারের ঘৃণিত সামরিক শাসকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলাদেশের মানুষের ওপর তার রাজত্ব ও কর্তৃত্ব বজায় রাখবেন। এর জন্য প্রয়োজনীয় গণসম্মতি আদায়ের কোনো প্রয়োজন তিনি অনুভব করেননি। ভেবেছিলেন তার কর্তৃত্ববাদী শাসনের ভ্রুকুটিতে বাংলাদেশের জনগণ চিরতরে নিশ্চুপ হয়ে যাবে। কিন্তু অতীত সাক্ষ্য দেয়, বাংলাদেশের মানুষ জ্বলে-পুড়ে ছাড়খার হবে, তবু মাথা নোয়াবে না। সীমাহীন হত্যাকাণ্ড চালিয়েও শেখ হাসিনার রক্ত পিপাসা মেটেনি। পদত্যাগের আগের দিন বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানদের ডেকে তিনি আরও নির্দয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি পুলিশ বাহিনীর কর্মকাণ্ডে সন্তোষ প্রকাশ করে তাদের আরও তৎপর হওয়ার নির্দেশ দেন। এই সময় পুলিশপ্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেছিলেন, ‘পুলিশের পক্ষে এর চেয়ে বেশি কিছু করা সম্ভব নয়।’ এই চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন একজন দলবাজ পুলিশ কর্মকর্তা। তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা বহাল আছে। আন্দোলন দমনে পুলিশকে আরও তৎপর হতে এ কর্মকর্তাকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে হবে। একজন পাবলিক সার্ভেন্ট কী করে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলকে দায়ী ঘোষণা করে বক্তৃতা দিতে পারেন, তা বুঝে ওঠা দুষ্কর। তবে শেখ হাসিনার শাসনামলে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দলীয়করণের নিকৃষ্টতম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। তার এক স্বাস্থ্য উপদেষ্টা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ছাত্রলীগ ছাড়া অন্যদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দেওয়া হবে না। আরেক উপদেষ্টা প্রয়াত এইচটি ইমাম বলেছিলেন, ছাত্রলীগের ছেলেরা যদি লিখিত পরীক্ষায় পাশ করতে পারে, তাহলে মৌখিক পরীক্ষায় তাদেরকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে। যেখানে দলীয়করণের মাত্রা এত ভয়াবহ, সেখানে সরকারি চাকরিকেন্দ্রিক কোটা আন্দোলন স্বাভাবিক নিয়মেই বেগবান হয়ে উঠেছিল।
বিরোধীদলীয় নেতারা যখন বললেন, আন্দোলনের তীব্রতায় শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হবেন, তখন শেখ হাসিনা দম্ভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালায় না। এর মাত্র দুদিন কী তিনদিনের মাথায় দেশত্যাগ করতে বাধ্য হলেন তিনি। শোনা গেছে দেশত্যাগের আগের রাতে তিনি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন। সেনাবাহিনী তাকে জানিয়ে দিয়েছিল ঢাকার গণভবনে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। বিদ্রোহী জনতা যে কোনো মুহূর্তে গণভবন দখল করে নিতে পারে। কুমিল্লা থেকে পরদিন তিনি ঢাকায় ফেরেন এবং তাকে জানানো হয় পদত্যাগ করতে হবে। তাকে আরও জানানো হয় তিনি মাত্র ৪৫ মিনিট সময় পাবেন। এর মধ্যেই তাকে দেশ ত্যাগ করতে হবে। তিনি চেয়েছিলেন, ক্ষমতা ছাড়ার সময় তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে একটি ভাষণ দেবেন। সময়াভাবে তাকে ভাষণ দিতে দেওয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে তার বিদায় ঘটেছে অত্যন্ত অমর্যাদাকর হৃদ্যতাহীনভাবে। তাকে বাংলাদেশের একটি হেলিকপ্টারে আগরতলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে তিনি ও তার বোন দিল্লি যান। দিল্লির নিকটবর্তী হিন্দান সামরিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। সেখানে ভারতীয় সামরিক কর্তারা তাকে গ্রহণ করেন। তিনি ব্রিটেনে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু ভিসা জটিলতার কারণে তার সেদেশে আশ্রয় নেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ মনে করছেন, তিনি শেষ পর্যন্ত বেলারুশ যাবেন। তার পুত্র জয় জানিয়েছেন, তার মা আর রাজনীতি করবেন না। তবে বাংলাদেশে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার রূপরেখা তিনি প্রণয়ন করেছিলেন। এখন তার বয়স ৭৬ বছর, ২০৪১ সালে তার বয়স হবে ৯৩ বছর। সে পর্যন্ত তার বেঁচে থাকা অসম্ভব নয়। অন্যদিকে ভারতীয় মিডিয়া ও অন্যান্য মহলে বাংলাদেশ নিয়ে যেসব আলোচনা হচ্ছে, সেগুলোও আমরা শুনতে পাচ্ছি। সেদেশের অনেকে মনে করছেন, হাসিনাকেন্দ্রিক তাদের একচোখা নীতির জন্য বাংলাদেশে তাদের পা রাখা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এখন বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের উচ্চমহলে পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। মালদ্বীপে ইন্ডিয়া-আউট রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সেদেশের স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। মালদ্বীপ অর্থনৈতিক কারণে ভারতের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। তা সত্ত্বেও মালদ্বীপ তার সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে পিছপা হয়নি। ভারতকে মালদ্বীপ থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করতে হয়েছে। এখন ভারত মালদ্বীপের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন সমীকরণ তৈরি করার চেষ্টায় লিপ্ত আছে। ভারতের অনেক মিডিয়ায় বলা হচ্ছে, ভারত পিঁয়াজ না পাঠালে বাংলাদেশে উনুনে রান্না চড়ানো সম্ভব হবে না। বাংলাদেশিদের উপোস করে মরতে হবে। এটুকু কষ্ট বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা জনগণ মেনে নিতে প্রস্তুত আছে। সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থানে এদেশের জনগণের ভারতবিরোধী মেজাজ দেখে কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন, দেশটা পাকিস্তান হয়ে গেল। ভারতের বড়ভাইসুলভ আচরণের বিরোধিতা করা কি পাকিস্তানমনা হওয়ার সমার্থক?
আন্দোলনের বর্তমান পর্যায়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগের মতো দুর্ঘটনা ঘটছে। এ ধরনের বেপরোয়া ঘটনা আদৌ গ্রহণযোগ্য নয়। এর ফলে যারা এ আন্দোলনকে বদনাম দিতে চাচ্ছে, তাদেরই ফায়দা হবে। এটা সত্য কথা, বিশাল আন্দোলন কখনোই ভদ্র, শান্তশিষ্ট মেজাজে আবদ্ধ থাকে না। সেজন্যই মাও সে তুং বলেছিলেন বিপ্লব এত সুনিপুণ শান্ত-সুন্দর হয় না। ভারতে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার পর দিল্লিতে ভয়াবহ শিখবিরোধী দাঙ্গা হয়েছিল। এর ফলে কয়েক হাজার শিখ নিহত হয়েছিলেন। এই ঘটনায় রাজীব গান্ধী মন্তব্য করেছিলেন, মহিরুহের পতন হলে মেদেনী তো কেঁপে উঠবেই। এসব সত্ত্বেও আমার কাছে এমন বিশাল রক্তক্ষরণের পর যে অর্জন জাতির সামনে সমাগত, তাকে কিছুতেই কালিমালিপ্ত করা যাবে না। কোনোরকম সাম্প্রদায়িক সুবিচার ব্যাহত করা যাবে না। দেশে নির্ভেজাল শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখাটাই এই মুহূর্তের প্রধান কর্তব্য।