বাজেট নিছক সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব নয়। বাজেটের মধ্য দিয়ে দেশ ও জনগণের জীবনের মানও নির্ধারিত হয়। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়নে বাজেটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। আমরা ইতোমধ্যে নিম্ন-মধ্যম আয় ও উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠেছি। বিশ্বের অনেক দেশ ইতোমধ্যে এই কাতারে পৌঁছেও এক প্রকার ফাঁদে পড়ে রয়েছে। এসব বিষয় মাথায় রেখে বলা যায়, এবারের বাজেট একদিকে যেমন ব্যবসাবান্ধব নয়, তেমনি জনবান্ধবও হয়নি।
বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভে পতন ও ডলার সংকটের মতো বিষয় বাজেটে সরাসরি আলোচিত হয়নি; পরোক্ষভাবে কিছু কথা এসেছে। এর সঙ্গে রয়েছে সংকটগ্রস্ত ব্যাংকিং খাত, দুর্নীতি, মুদ্রা পাচার, সরকারি প্রকল্পগুলোতে বিভিন্ন অপচয়, পুঁজিবাজারের অবস্থা ইত্যাদি। এসব আর্থিক সমস্যা ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব ফেলে। অথচ বাজেটে এসব বিষয়ে কোনো বিশেষ দিক বা নতুন কিছু দেখছি না। শুধু আগের বাজেটের কিছু কিছু জায়গায় অনুল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা হয়েছে। বলা হচ্ছে, সংকোচনমূলক বাজেট। অথচ বাজেটের ঘাটতি সংকোচনমূলক মনে হয় না।
সরকার ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে। এতে বেসরকারি খাতে ঋণ কমে যেতে পারে। আর ব্যক্তি খাত ঋণ না পেলে কর্মসংস্থান হবে কীভাবে? এ অবস্থায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাত। এখনও মূল্যস্ফীতি বেড়েই চলেছে। এটি শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের বিষয় নয়। আমরা সবাই এর সঙ্গে যুক্ত। গৃহীত ব্যবস্থায় মূল্যস্ফীতি হয়তো কিছুটা কমতে পারে। তবে সাড়ে ৬ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে মনে হয় না। কারণ বাজেটে উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলা হলেও সেটি খুব বেশি বাড়বে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া বাজার সিন্ডিকেটের লাগাম টানতে তেমন কোনো পদক্ষেপ নেই। বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।
বর্তমানে ব্যাংকিং খাত এক বিপর্যস্ত অধ্যায় পার করছে। দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের ঠিকঠাক সুবিধা দিতে পারছে না। আর্থিক খাত যদি যথাযথভাবে দাঁড়াতে না পারে তাহলে খুব শিগগির ব্যবসার ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভাব পড়লে সরকার কাদের কাছ থেকে কর তুলবে? ভ্যাটের টাকা কীভাবে নেবে? ক্ষুদ্র, মাঝারি ব্যবসায়ীরা যদি টাকা না পান, তাহলে দেশের অর্থনীতির অবস্থা আরও বিরূপ হবে। তবে বড় ব্যবসায়ীরা কানেকশনের কারণে ঋণ পেয়ে যাবেন, তাতে সংকট কাটবে না।
কর্মসংস্থানের বিষয়টিও চলে আসে। দেশে হাজার হাজার লোক বেকার। প্রতিবছর এ সংখ্যা বাড়ছে। অন্যদিকে দেশে বিশাল একটি পেশাজীবী শ্রেণি রয়েছে। এদের আবার আয় বাড়ছে না, বরং ব্যয়ের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। দ্রব্যমূল্য ক্রমে ঊর্ধ্বগতির দিকে। সরকার বাজার ব্যবস্থাপনার এ সংকট নিরসন করতে না পেরে অনেকটা হিমশিম খাচ্ছে। বাজেটের দুর্বলতাগুলো বাজারে প্রভাব ফেলবে। সুতরাং দ্রব্যমূল্য যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সিন্ডিকেট বন্ধ করা যাচ্ছে না। তাই এবারের বাজেট বাজার ব্যবস্থাপনায় সুফল বয়ে আনবে না।
আমরা দিন দিন ঋণনির্ভর হয়ে যাচ্ছি। দেশে ঋণ তো বাড়ছেই, এর সুদও বাড়ছে। এ ছাড়া বিদেশি ঋণ ব্যাপক হারে বেড়ে যাচ্ছে। ঋণ ও সুদ পরিশোধের সামর্থ্য থাকতে হবে। আমাদের রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। তাহলে কী দিয়ে ঋণ পরিশোধ করব? ইতোমধ্যে সরকার বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক ঋণ নিয়ে বসে আছে। গত ১০ বছরে আমাদের বৈদেশিক ঋণ প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়েছে। সরকারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ গত অর্থবছরের তুলনায় এ বছর ৬৩ শতাংশ বাড়তে পারে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসেই ঋণের সুদ ও আসল বাবদ খরচ ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে সরকারকে সুদসহ ৩০৬ কোটি ৮১ ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ২৪৬ কোটি ডলার সুদসহ পরিশোধ করতে হয়েছিল। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এবার ৬০ কোটি ডলার বেশি পরিশোধ করা হয়েছে। এতে দেশের কোষাগারে নতুন করে চাপ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।