আইএমএফের যে ঋণ কর্মসূচিতে বাংলাদেশ রয়েছে, তার তৃতীয় কিস্তিটাও পাওয়া গিয়েছিল। এটা আবার পরিমাণে ছিল প্রতিশ্রুতির প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি। ডলারে বেশি করে প্রাপ্তি বাংলাদেশ সরকারের জন্য এ মুহূর্তে জরুরি বৈকি। কেননা বিদেশি মুদ্রা তথা ডলারের বড় সংকটে আছে দেশ। আরেকটি নতুন অর্থবছরে ঢুকে পড়েছি; কিন্তু চলে আসা ডলার সংকট আমাদের ছাড়ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য মোট রিজার্ভ কিছুটা বাড়িয়ে দেখিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করতে চাইছে যে, পরিস্থিতি আছে নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু এ মুহূর্তে ব্যবহারযোগ্য তথা নিট রিজার্ভ যে সংকটেই রয়েছে, সেটা আড়াল করা যাচ্ছে না।
মূলত ডলার সংকটে পড়ে আইএমএফের সহায়তা গ্রহণের কারণেও নিট রিজার্ভ জানা হয়ে যাচ্ছে আমাদের। কেননা সংস্থাটি ঋণের কিস্তি অনুমোদনের সময় নিট রিজার্ভকে একটা স্তরে রাখার শর্ত দিয়ে যাচ্ছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে সেটা করতে হচ্ছে পালন। না পারলে এর কারণ ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে। এ ঋণ কর্মসূচিতে আইএমএফের আরও কিছু শর্ত অবশ্য রয়েছে। এর কিছু প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা আমরা দেখতে পেয়েছি নতুন বাজেটেও। যেমন, কর অব্যাহতি থেকে বেরুতে চাওয়া। সেটা পুরোপুরি না পারলেও সরকার এ ধারায় প্রবেশ করেছে। ভর্তুকি থেকে বেরিয়ে আসায়ও জোর দিচ্ছে আইএমএফ। সরকার দেরিতে হলেও এটাকে গ্রহণ করেছে নীতি হিসাবে। এর আওতায় বিদ্যুতের দাম ধাপে ধাপে বাড়ানোর কর্মপন্থা নিয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম করা হয়েছে ‘বাজারভিত্তিক’।
আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তি সম্পর্কিত আলোচনা চলাকালে আর্থিক খাতের বড় দুটি সংস্কারেও প্রবেশ করেছে সরকার। এক. ব্যাংকঋণের সুদের হার থেকে ‘ক্যাপ’ উঠিয়ে দিয়ে একে বাজারভিত্তিক করার পদক্ষেপ। দুই. মুদ্রার বিনিময় হারকেও বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কার্যক্রম গ্রহণ। তাতে এরই মধ্যে ঋণের সুদের হার বৃদ্ধির পাশাপাশি স্থানীয় মুদ্রার বড় অবমূল্যায়ন ঘটেছে; ঘুরিয়ে বললে, ডলারের ‘আনুষ্ঠানিক দাম’ গেছে বেড়ে। ডলারের দামে রাতারাতি ৭ টাকা বৃদ্ধির ঘটনা এরই মধ্যে দেখতে হয়েছে। এর ভালো-মন্দ নিয়েও চলছে আলোচনা। এর মধ্যে এ কথাটা বারবারই বলা হচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সুদের হার বা ডলারের দাম কোনোটাই আটকে রাখা উচিত হয়নি। বছরের পর বছর এটা চালিয়ে যাওয়া হয়েছে আরও অনুচিত। তাতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়লেও না হয় কথা ছিল। এটাও তো পরিষ্কার যে, ডলার বাজার ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা ছিল বিরাট। এতে হুন্ডিতে রেমিট্যান্স প্রেরণ বেড়ে উঠেছে; রপ্তানি আয় দেশে না আনার প্রবণতাও বেড়েছে অনেক। করোনা পরিস্থিতিতে বেড়ে ওঠা ডলারের মজুত তথা রিজার্ভ ক্ষয়ও রোধ করা যায়নি।
রিজার্ভ ক্ষয় হতে হতে এমন পর্যায়ে চলে এসেছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংক তথা সরকারকে যেতে হয়েছে আমদানি নিয়ন্ত্রণে। ব্যাপকভাবে আমদানিনির্ভর একটা দেশ আমদানি নিয়ন্ত্রণ করলে তার হাতে থাকা ডলারের ওপর চাপ হয়তো কমে; কিন্তু প্রবৃদ্ধি যায় সংকুচিত হয়ে। আমদানি নিয়ন্ত্রিত হলে এর রপ্তানি খাতের বিকাশও হয় ব্যাহত। দেশটি তো এমন একটি রপ্তানি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে আছে, যা উৎপাদন করতে হয় ব্যাপকভাবে কাঁচামাল আমদানি করে। গেল অর্থবছরে এ খাতে (তৈরি পোশাক) ৪ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এক্ষেত্রে অনেক কিছুই দায়ী; তবে ডলার সংকটের ভূমিকাও স্বীকার করতে হবে। খাদ্যপণ্য আমদানিও হ্রাস পেয়েছে বিগত অর্থবছরে। চাল ছাড়া বলতে গেলে সব গুরুত্বপূর্ণ পণ্যই কিন্তু আমদানি করতে হয়। বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে খাদ্যপণ্যের দামও বেড়ে গিয়েছিল অনেক। বেড়ে গিয়েছিল সার, ডিজেল ও এলএনজির মতো পণ্যের দাম। এসবও বিপুল পরিমাণে আমদানি করতে হয়। অন্যান্য পণ্যের আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে হলেও এগুলোর আমদানি রাখতে হয়েছে সচল।