বাবা-মাকে নিয়ে কোনো কিছু লেখা যে এতটা কঠিন তা আগে বুঝিনি। ওদের নিয়ে কিছু লিখতে বসলেই কিবোর্ডে হাত চলে না, স্ক্রিন ঝাপসা হয়ে ওঠে চোখের জলে। মাথায় ভিড় করে রাজ্যের সব স্মৃতি। কোথায় যেন হারিয়ে যাই। কখনো শৈশবে কখনো কৈশোরে বা আমার জীবনকালের লক্ষ-নিযুত ঘটনা, কথা কিংবা শব্দাবলী মাথার মধ্যে এসে গিজগিজ করতে থাকে। থমকে যায় আঙুল। ভাবাই হয় কেবল কিন্তু লেখা আর হয়ে ওঠে না।
বাবাকে দেখেই লেখালেখির দিকে ঝোঁক তৈরি হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার অনেক পরে। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতাম ভোর ৫টা-সাড়ে ৫টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠেই বাবা বসে পড়তেন ডাইনিং টেবিলে, শুরু হতো তার প্রতিদিনের নিয়মিত লেখালেখি। বাবাকে নিয়মিত লিখতে দেখলাম যখন তিনি দৈনিক বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব ছেড়ে ফিরে এলেন ঢাকায় এবং ১৯৮২ সালে যোগ দিলেন প্রেস ইন্সটিটিউটে। এর আগে তিনি বাসায় কস্মিনকালে লিখতে বসতেন না।
দৈনিক পত্রিকায় কাজ করার সময় তিনি বাড়িতে থাকতেন খুব কম সময়, ঘুম আর খাওয়াদাওয়া ছাড়া তাকে আমরা বাসায় পেতাম খুব কম সময়। এর বাইরে যে সময়টুকু তাকে বাসায় দেখা যেত তা হয় কোনো মিটিং বা তার সাংস্কৃতিক সংগঠনের রিহার্সেলের প্রয়োজনে। যে সময়টায় তিনি সংবাদপত্রে কাজ করতেন এবং সাংবাদিক ইউনিয়নে যুক্ত ছিলেন শুনেছি সেই সময়ে তিনি প্রেসক্লাবে কিংবা পত্রিকা অফিসেই লেখার সময় বের করে নিতেন। তাই প্রেস ইন্সটিটিউটের বাঁধাধরা অফিসের বাইরে লেখার জন্য পেয়েছিলেন বাড়তি সময়। ৮০-র দশকের শুরু থেকেই তার বেশিসংখ্যক লেখা তিনি প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এবং কয়েকটি বইয়ে।
আমি তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি, বোঝার মতো যথেষ্ট জ্ঞান হয়েছে, বাবাকে বুঝতে শুরু করেছিলাম তখন থেকেই। তাই ১৫ আগস্ট পরবর্তী জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসনামলে শত প্রলোভনে দেখতাম শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। ৭৬-এর মাঝামাঝি আর্থিক টানাপোড়েন থেকে মুক্তির প্রয়োজনে শুরু করলেন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্রবন্ধের অনিয়মিত সংকলন ‘স্বাধীনতা’ প্রকাশ। এই প্রথম আমার সুযোগ হলো বাবার সাথে কাজ করার। সংকলনটির লেখা সংগ্রহ থেকে শুরু করে কম্পোজ, প্রুফ, প্রচ্ছদ ডিজাইন, ব্লক তৈরি, বিজ্ঞাপন জোগাড়, মানে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এক বছর বাবার সাথে কাজে যুক্ত থেকে প্রকাশনার আদ্যোপান্ত জানতে শুরু করলাম। সেই সময় বাবার কাছ থেকেই আর্টিকেল সম্পাদনা সম্পর্কে জানার সুযোগ হলো। সেই আমার সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। আর এরই টানে কীভাবে যেন শেষ পর্যন্ত চল্লিশের কোঠায় এসে সাংবাদিকতাকেই পেশায় রূপ দিয়ে ফেললাম।
তিনি যে তার কাজ বা আন্দোলন বা লড়াই-সংগ্রামে কতটা একনিষ্ঠ ছিলেন এখন তা বুঝতে পারি। যখন কোনো কাজে একবার ঢুকে পড়তেন তখন তাতে মগ্ন হয়ে নিজের সবটুকু ঢেলে দিতেন। এইক্ষেত্রে আমার মা, দীপ্তি লোহানী ছিলেন তার সবচেয়ে বড় শক্তি। তাই মা’র ওপর পুরো পরিবারের ভার দিয়ে বাবা ঢাকা ছেড়েছিলেন মুজিবনগরের উদ্দেশ্যে, আবার ২১ ডিসেম্বর রাতে কলকাতায় আমাদের রেখে এক কাপড়ে ঢাকা ফিরে আসতে পেরেছিলেন। তার প্রবল আস্থা ছিল স্ত্রীর ওপরে তাই কলকাতা শহরে আমাদের কী হবে ভাবেননি একটুও। শুধু মাকে বলেছিলেন, ‘স্বাধীন বাংলা বেতারে যোগাযোগ করো ওরাই ঢাকা ফেরার সব ব্যবস্থা করবে’। আমরা ফিরেছিলাম দেড় মাস পরে।