বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় স্বপ্না নামের মেয়েটির স্বামী তাঁকে নতুন ফ্ল্যাট, দামি গাড়ি, দামি শাড়ি, অলংকার, গোছানো ড্রয়িংরুমসহ অনেক কিছুই কিনে দিয়েছেন। আপাতদৃষ্টে কিছুরই যেন অভাব নেই সংসারে। কিন্তু তাতেও স্বপ্না সেভাবে হাসিখুশি থাকতে পারছেন না। সব সময় একটা ভয়, জড়তা তাঁকে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। স্বপ্নার এই ভীত চেহারা বন্ধু ও সহকর্মীদের কারও নজর এড়ায় না। সবাই দেখছে স্বপ্নার সব আছে, স্বামী সকালে গাড়িতে করে অফিসে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন, বিকেলে তুলে নিয়েও যান। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? স্বপ্না তো কারও কাছে কোনো অভিযোগ করছেন না।
স্বপ্না তাঁর এই দুঃখটাকে লালন করেন ভেতরে। কাউকে লজ্জায় কিছু বলেন না। খুব তুচ্ছ কারণে স্বামী যে তাঁকে সবার সামনে এবং বন্ধ দরজার ভেতরে অপমান করেন, এটা তাঁকে প্রতিনিয়ত কষ্ট দেয়। স্বপ্না এটা মেনে নিতে পারছিলেন না, আবার প্রতিবাদও করতে পারছিলেন না। এই জাঁতাকলে পড়ে মেয়েটির নিজের কাজ ব্যাহত হচ্ছিল, অন্যমনস্কতা বাড়ছিল, সন্তান তাঁর ব্যবহারের প্রতি শ্রদ্ধা হারাচ্ছিল এবং পরিবারের অন্যরা এই দুঃখবোধকে ঢং বলে মনে করতে শুরু করেছিল। স্বপ্না একটি উদাহরণমাত্র, তাঁর মতো আরও অসংখ্য চরিত্র আছে এই সমাজে, যাঁরা গ্যাসলাইটিং অর্থাৎ জবরদস্তিমূলক নিয়ন্ত্রণের শিকার।
সঙ্গীকে সবার সামনে ছোট করা, অবিশ্বাস ও অসম্মান করাটা যে একধরনের অত্যাচার, তা সমাজের অধিকাংশ মানুষ মনে করেন না। সবাই তা অনুভবও করতে পারেন না। নির্যাতন সব সময় শারীরিক না-ও হতে পারে। মানসিকভাবে হেনস্তা করা ও লজ্জা দেওয়ার মাধ্যমেও মানুষকে নিপীড়ন করা যায়। সেদিন ওয়েব সিরিজ লজ্জা দেখে মনে হলো আমি অথবা আমার চারপাশে অনেকেই এ রকম নির্লজ্জ আচরণের শিকার।
সিরিজটিতে খুব চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গ্যাসলাইটিংয়ের মতো বিষয়টিকে। এখানে যে মূল নারী চরিত্র, তার জীবনের গল্পের সঙ্গে এ দেশের অনেক নারীর জীবনের মিল আছে। অবশ্য শুধু গালিগালাজ করা বা অশ্রাব্য কথা বলাই মৌখিক নিগ্রহ নয়। ‘তোর বা তোমার দ্বারা কিছু হবে না’—আপাতদৃষ্টে সামান্য এই কথাটা দিনের পর দিন কাউকে বলে যাওয়ার মাধ্যমেও ভেঙে দেওয়া যায় মানুষের মনের জোর। সামাজিক পরিসরে, গৃহ অভ্যন্তরে বা বেডরুমের ভেতরে এমনভাবে সঙ্গীকে লজ্জা দেওয়া যায়, যাতে সঙ্গীর মনোবল একেবারে তছনছ হয়ে যায়। কারও আত্মবিশ্বাস নষ্ট করা বা কাউকে হেয় করার মাধ্যমে তাঁকে অসহায় ও দুর্বল করে ফেলার একটা ভালো অস্ত্র হচ্ছে তাঁকে ক্রমাগত লজ্জা দেওয়া। লজ্জা দেওয়ার মাধ্যমে অন্যকে হেয়, সন্দেহ ও নিয়ন্ত্রণ করার এই অসুখের একটি নাম আছে। এর নাম ‘গ্যাসলাইটিং’। শুধু সিনেমার পর্দায় নয়, আমাদের চারপাশে ঠিক এমন দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়।