অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ব্রিটিশ-ভারত যখন ঔপনিবেশিক শাসনে, শোষণে ও পেষণে ক্ষতবিক্ষত, পুঁজিতন্ত্রের চলমান প্রক্রিয়াটি যখন মন্থর ও বিকৃত, ঠিক সে সময় নজরুলের জন্ম হয় পশ্চিমবঙ্গের এক অজপাড়াগাঁয়, হতদরিদ্র এক মুসলিম পরিবারে। সে সময় সমাজের প্রতিটি স্তরে বৈষম্য এবং নিপীড়ন এতটা প্রকট ছিল, সমাজে একটি বিস্ফোরণ অনিবার্য হয়ে উঠল। উদাহরণস্বরূপ সে সময় ভারতে সিভিল সার্ভিসে কর্মরত ৮ হাজার ব্রিটিশ রাজকর্মচারীর মোট বেতন ছিল ১.৪ কোটি পাউন্ড স্টার্লিং আর ১ লাখ ৩০ হাজার ভারতীয় কর্মচারীর বেতন ছিল মাত্র ৩০ লাখ পাউন্ড। এ সময় চাকরিহীন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ভারতীয় ছাত্রের সংখ্যা ছিল প্রায় দশ লাখ এবং তারা প্রায় সবাই বিপ্লবী চেতনায় ছিল ঐক্যবদ্ধ। তাই বিস্ফোরণের সব বীজ সুপ্ত ছিল সমাজে। এর ওপর নানা কৃষক বিদ্রোহের মাঝে গ্রামীণ কৃষকও হয়ে ওঠে দ্রোহমুখী। এসবের মাঝে ১৮৯৬-১৯০৮ সালে ৬.২ কোটি, ১৮৯৯-১৯০০ সালে ২.৮ কোটি, ১৯০৫-১৯০৬ সালে ৩৩ লাখ, ১৯০৬-১৯০৭ সালে ১.৩ কোটি, ১৯০৭-১৯০৮ সালে ৪.৯৬ কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষকবলিত হয়ে পড়েছিল। ১৮৯৬-১৯০৮ সালে ভারতে ৬০ লাখ লোক দুর্ভিক্ষের বাইরে কেবল প্লেগ রোগেই মারা গিয়েছিল। এছাড়া কলেরাসহ দুর্ভিক্ষজনিত নানা রোগ ও মৃত্যুতে হতাশাগ্রস্ত দরিদ্র সাধারণের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছিল। এ নিরাশার আঁধার ও অসন্তোষের আগুন থেকে মুক্তি আন্দোলনের বহ্নিশিখা জেগে ওঠে। এর মাঝে ১৮৯৯-এ লর্ড কার্জন যখন নানাবিধ দমনপীড়ন এবং নিগৃহমূলক নীতি গ্রহণ করেন, তখন জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ঝান্ডা নিয়ে এগিয়ে আসেন শ্রী তিলক। এতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে মহারাষ্ট্রের যুবসমাজ। মারাঠা ও মহারাষ্ট্রের অনুসরণ করে বাংলা। জাতীয় মুক্তি আন্দোলন দানা বাঁধে। ১৯০২ সাল থেকে নানা গুপ্ত সমিতি গঠিত হয়। তিলককে অনুসরণ করে বাংলায় উঠে আসে বিপিন চন্দ্র পাল, শ্রী অরবিন্দ ও পাঞ্জাবের লালা লাজপৎ রায়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ ঘোষিত হলে স্বদেশি আন্দোলন বেগবান হয় বাংলার শহর ও গ্রামে। এ সময় প্রকাশিত হয় ‘যুগান্তর’ ও ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকা।
এ ভয়াবহ সময়টা ছিল হতদরিদ্র নজরুলের নজরুল হয়ে ওঠার কাল এবং পেছনের আবহচিত্র। গ্রামের মসজিদে তার ইমামতি, রুটির দোকানে কাজ, লেটোদের সঙ্গে গানে-তালে মিশে যাওয়া, তারপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিক হিসাবে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস তীরে ভ্রমণ, অস্ত্রের ঝনঝনানি, বারুদের গন্ধের মাঝে ইরান-তুরানের লৌকিক সংগীত ও মরমিবাদ আত্তীকরণ-সবই ঘটে নজরুলের জীবনে। কবিতা ও গানে অবিনাশী নজরুল হওয়ার পেছনে তার এ পথচলার একটি বিশাল ভূমিকা ছিল। পৃথিবীর পাঠশালায় শিক্ষার উদাহরণ দেখিয়াছেন নজরুল। দুঃখ, দুর্দশা এবং যুদ্ধ মানুষের চেতনা ও বোধকে কতটা তীক্ষè এবং প্রতিবাদের ভাষাকে কতটা শানিত করে, কতটা গভীর করে, তা আমরা দেখেছি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধোত্তর শিল্প ও সাহিত্যে। নজরুল সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বুদ্ধদেব বসু বলেন-‘বাংলা কাব্যের ইতিহাসে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পরে সবচেয়ে বড় কবিত্বশক্তি নজরুল ইসলামের। তিনি যখন সাহিত্য ক্ষেত্রে এলেন, তখন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার খ্যাতির চূড়ায় অধিষ্ঠিত, মোহিতলাল তখনো ঠিক সমাগত হননি, রবীন্দ্রনাথের পর সত্যেন্দ্রনাথই প্রধান কবি। নজরুলের রচনায় সত্যেন্দ্রীয় আমেজ ছিল না তা নয়-কেনই বা থাকবে না-কিন্তু প্রথম থেকেই তিনি সুস্পষ্ট এবং প্রবলভাবে তার স্বকীয়তা ঘোষণা করেছিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশ তাকে গ্রহণ করল, স্বীকার করল-নজরুল সম্বন্ধে বিশেষভাবে বলার কথা এইটাই যে, তিনি একইসঙ্গে লোকপ্রিয় কবি এবং ভালো কবি-তারপর একমাত্র সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মধ্যেই পলকের জন্য এ সমন্বয়ের সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন-‘অদম্য স্বতঃস্ফূর্তি নজরুলের রচনার প্রধান গুণ-এবং প্রধান দোষ। যা কিছু তিনি লিখেছেন, দ্রুতবেগে; ভাবতে, বুঝতে, সংশোধন করতে কখনো থামেননি, কোথায় থামতে হবে দিশে পাননি। ... বায়রণ সম্বন্ধে গেটে যা বলেছিলেন, নজরুল সম্বন্ধেও সে-কথা সত্য : The moment he thinks, he is a child....’
তিনি অতিসত্বর ফুরিয়ে যাবেন বলেই হয়তো এমনভাবে মধ্য গগনে দেদীপ্যমান ছিলেন। চিরনীরব হবেন বলেই হয়তো অপরের কথা শোনার ফুরসত হয়নি তার। তারপরও তিনি মহাকবি বা অমর কাব্য সাহিত্যের কারিগর হতে চাননি। তিনি মানুষের প্রাণের কথা মনের কথা, আকাক্সক্ষার কথা এবং স্বপ্নের কথা উচ্চকণ্ঠে বলতে পেরেছিলেন।
নজরুলের সার্থক তুলনা আমেরিকান কবি হুইটম্যান; যিনি বলেছিলেন, Behold I don’t give little charity, when I give, I give myself। নজরুল ছিলেন অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও স্পষ্ট; ভাবনায় ও কথনে। বোদলেয়ায়ের মতো গভীর অন্তর্জ্বালা থাকলেও তিনি তাকে প্রশ্রয় দেননি। গুরুত্ব দিয়েছেন সাম্যবাদী চিন্তা এবং মানুষের মুক্তির চিন্তাকে। তিনি নির্মাণ করেছেন মানুষের স্বপ্ন। শেকল ভাঙার গান শিখিয়েছেন সবাইকে। কমরেড মোজাফ্ফরের সঙ্গে থাকাটা তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল।